Sunday 3 July 2016

"বিভীষিকার রাত"
-দোয়েল

আমি ভীষণ ভীতু প্রকৃতির মেয়ে। কিন্তু ভূতের শুনতে বা পড়তে আমি খুব ভালোবাসি। এককথায় ভূতের গল্প আমায় যেন টানে। এই টান টা বড় অদ্ভুত, তাই না?সত্যি, আমারও বড়ই অদ্ভুত লাগে। কিন্তু এই টান টা বেশ রোমাঞ্চকর। যাইহোক, এবার গল্পে আসি...
এখনও স্পষ্ট মনে পড়ে সেই রাতটার কথা। ২০১০-এর জুলাইয়ের একটা রাত ছিল সেদিন। পরেরদিন ঈদ, আর তার দুদিন বাদেই রথযাত্রা। তো সেদিন রাতে একটা নাচের প্রোগ্রাম ছিল আমার। প্রোগ্রাম শুরু হবে রাত ৯টায়, আমার বাড়ি থেকে বেরানোর কথা তাই ৭ টার দিকে। ব্যাগপত্র গুছিয়ে রেডি হয়েছি সবে, হঠাৎ তুমুল ঝড়বৃষ্টি শুরু হল। আর যেখানে একটু বাতাস বইলেই কারেন্ট ছুটি নেয়, সেখানে এই তুমুল ঝড়বৃষ্টিতে বিদায় নেওয়া কারেন্ট যে কখন আসবে আবার, সে কোনও ঠিক নেই। আগেরদিন আমাদের গলিতে একটা মেয়ে খুন হয়ে গেছে। তাই বাড়ি থেকে বেরোয়নি কেউ, সবাই বাড়িতেই আছে। মুখে অনেকেই সাহস দেখায়, কিন্তু ভেতরে ভেতরে ভয়ে মরে। আমিও কালকের খুনের পর সাহস দেখিয়ে বলেছিলাম যে প্রোগ্রামটা আমি করতে যাবোই। কিন্তু এই ঝড়বৃষ্টির রাতে... এমনিতেই আমি ভীতুর ডিম, তারুপর কালকের খুন... বাড়ির বাইরে যাওয়াটা এইসময় আমার কাছে একরকম প্রচণ্ড চাপের। হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠলো। আমাদের নাচের গ্রুপের মধুর ফোন, প্রোগ্রাম বাতিল হয়ে গেছে। আনন্দে যেন নেচে উঠলাম। এই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতে বাইরে যাওয়ার একদমই ইচ্ছে ছিলনা। এখন বাড়িতে মায়ের বানানো তেলেভাজা, গরম চা, আর মুড়ি, সাথে সবার সাথে জমিয়ে আড্ডা, সন্ধ্যাটা পুরো জমে যাবে। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে দাদাকে ধরলাম একটা ভূতের গল্প বলতে, দাদা বেশ ভালো ভূতের গল্প বলতে পারে। দাদা বেশ ভয়ঙ্করভাবে গল্প শুরু করলো। ভয়ঙ্করভাবে বলতে, দাদা যখন ভূতের গল্প বলে দাদার মুখচোখের ভাব বেশ বদলে যায়, একটা ভয়ঙ্কর ভাব ফুটে ওঠে পুরো মুখ জুড়ে। গল্প করতে করতে হঠাৎ করেই দাদা আগের দিনের খুন হয়ে যাওয়া মেয়েটিকে নিয়ে ইয়ার্কি শুরু করলো, “দেখিস ওই মেয়েটা ভূত হয়ে এসে তোর ঘাড় মটকে দিয়ে যাবে...” এটা দাদার বরাবরের স্বভাব, আমাকে ভয় দেখানো। মেয়েটি আমাদের পাশের বাড়িতেই থাকতো, আমাদের কলেজেই পড়তো, আমার সাথে খুব একটা ভাব না থাকলেও মাঝেমধ্যেই কথা হত। মেয়েটি মুসলিম বলেই আমি এড়িয়ে চলতে চাইতাম তাকে। তাও বারবার পুলিশ আসছে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য। আমার আর দাদার এই খুনসুটির মাঝেই হঠাৎ কলিং বেল বেজে উঠলো। এই ঝড়বৃষ্টির রাতে আবার কে এলো! পুলিশগুলোই হবে বোধহয়। বেশ বিরক্ত হয়েই টর্চ নিয়ে দরজা খুলতে গেলাম। দরজা খুলে দেখি কেউ নেই। আমাদের পাশের বাড়ির বাচ্চাটা মাঝেমাঝেই এমন দুষ্টুমি করে, সে হতে পারে ভেবে একটু রাগ ধরল। দরজা বন্ধ করে পেছন ঘুরে দাদাকে দেখতে পেলাম না। আরে দাদা তো এখুনি ওই চেয়ারটায় বসে ছিল, গেল কৈ! আবার টর্চের আলো ফেললাম চেয়ারে, কে যেন বসে আছে চেয়ারে। ডাক দিলাম, দাদা? হঠাৎ একটা মেয়ে উঠে দাঁড়ালো চেয়ার থেকে। আমার টর্চটা বন্ধ হয়ে গেল হঠাৎ, অন্ধকারে মেয়েটির চোখ দুটো যেন আগুনের ফুলকির মত জ্বলছে। মেয়েটি এগিয়ে আসছে আমার দিকে আর বলছে “ঈদ মোবারক”... আমি চেল্লাতে গেলাম মাকে ডেকে... গলা দিয়ে কোনও আওয়াজই বের হলনা। অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাওয়ার আগে পাশের বাড়ির খুন হয়ে যাওয়া মেয়েটির মুখ মনে পড়ল... আমার মুখ দিয়ে অস্ফুটে বেরিয়ে এল, রেশমি!
পরেরদিন বিকেলে যখন আমার জ্ঞান ফিরল, মা, বাবা, দাদা, মাসিমনি সবাই পাশে বসে আমার, গায়ে ধূমজ্বর। কিন্তু জ্বরের কোনও কারণ নাকি ডাক্তার খুঁজে পায়নি। অনেক কটা টেস্ট হল, তাও কিছু ধরা পড়লনা। দাদা বলল, তুই আমাকে দেখে ওভাবে ভয় পেয়ে পড়ে গেলি কেন? আমি চুপ করে রইলাম, জানি আমার কথা কেউ বিশ্বাস করবেনা। শুধু আমার মনেই আজও থেকে গেছে সেই রাত এক বিভীষিকা হয়ে।

No comments:

Post a Comment

মনের কথা-Moner Katha