Tuesday 5 July 2016

"পেপারওয়ালা"
-সৌরভ ভূঞ্যা (
Sourav Bhunia)

সুমন প্ল্যাটফর্ম থেকে দেখে নিল অন্ধকারে নিঝুম বস্তিটার দিকে । আবার ছোখ চলে গেল লাইনের বিপরীত দিকে আলোকময় রেলবাবুদের তিনতলা পাকা বাড়িগুলোর দিকে । এই বাড়িগুলোই তাদের জীবিকার উৎস । সুমন প্রতিদিন ৪ টা ৩০ মিনিট থেকে লাইনের উপর হাঁটে কয়েক কিলোমিটার, আবার ফিরে আসে । এটা তার অভ্যাস । যেদিন যেতে পারেনা সেদিন সারাদিন কোনো কাজও করতে পারেনা ঠিক করে ।
সুমন মায়ের কাছে শুনেছিল, ওর বাবা নাকি খুব বড়ো বাড়ির ছেলে ছিল, কিন্তু মা ছিল খুব গরীব বাড়ির মেয়ে । তাই সুমনের দাদু এই বিয়ে মেনে নেয়নি । সুমনের বাবা নিজের জমানো পাঁচ হাজার টাকা আর মাকে নিয়ে চলে এসে এই স্টেশনের কাছে একটা বাড়ি ভাড়া নেয় । সুমনের দাদুর অঢেল সম্পত্তি ছিল, তাই বাবা বেশিদুর পড়েনি । ঠিক করল পেপার বিক্রি করবে । সকাল ১০ টা পর্যন্ত পেপার বিক্রি করে রেল অফিসারদের কিছু কাজ করে দিত যেমন বাজার করে দেওয়া, রান্নার গ্যাস এনে দেওয়া ইত্যাদি । এত বড় বাড়ির ছেলে হয়েও কোনোদিন কিন্তু বোধ করেনি এইসব কাজ করতে । সুমনের মা ঠোঙা বানাত বাড়িতে বসে । তাই মোটামুটি চলেই যাচ্ছি সংসারটা । কিন্তু ভগবান নাকি সুখের সংসার দেখতে পারেন না ।
সুমনের এখনো মনে পড়ে সেই দিনটার কথা পরিষ্কারভাবে । সুমনের বয়স তখন ১৪ । বাবার আসতে দেরি হচ্ছে দেখে স্টেশনে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল প্ল্যাটফর্মে । তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরার জন্য উল্টো দিকের প্ল্যাটফর্মে নেমেছিল বাবাও । তাড়াতাড়ি করতে গিয়ে খেয়াল না করা উল্টো দিকের এক্সপ্রেসটা টুকরো টুকরো করে দিয়েছিল বাবার শরীরটাকে । চোখের সামনে ঘটনাটা ঘটে গেলেও চেঁচিয়ে বাবাকে সাবধান করার সময়টুকুও পায়নি সুমন । সেদিনের পর সুমনদের সংসারে নেমে এসেছিল কালো ছায়া । যে ট্রেন তাদের প্রতিদিনের খাবার জোগাড় করত সেই ট্রেনই কেড়ে নিল সব কিছু ।
সুমনদের বাড়ির উঠোনের মাঝে একটা পুরানো আমগাছ ছিল । হঠাৎ কারা যেন সেটাকে কেটে নিয়ে গেল একদিন । কয়েকদিন মনে হচ্ছিল কিছু একটা যেন নেই, তারপর চোখে সয়ে গেল, ধীরে ধীরে বাবার মৃত্যুটাও । কিন্তু আমগাছ না থাকায় যেমন আর ফল পাওয়া যাবেনা, তেমনি বাবা না থাকায় সংসারের টান শুরু হল ।
সুমনের মা প্রথমে ভেঙে পড়লেন খুব । কিন্তু তারপর সুমনের মুখের দিকে তাকিয়ে শক্ত করলেন নিজেকে, শুরু হল বেঁচে থাকার লড়াই । বাড়িভাড়া দেওয়ার ক্ষমতা নেই আর । ভাড়াবাড়ি টা ছেড়ে দিতে হল । সুমনের বাবাকে খুব ভালোবাসতেন রেলের অফিসাররা । তাদের সাহায্য নিয়ে রেলের একটু ফাঁকা জমিতে ছোট একটা বেড়া দেওয়া চালাঘর বানালেন মা । বাড়ির চালে টিন দেওয়ার জন্য অবশ্য সুমনের মা কে নিজের পুরনো কিছু গয়না বিক্রি করতে হয়েছিল । না, সুমন পড়াশোনা ছাড়েনি । যদিও সংসার চালাতে মা কে সাহায্য করতে বাবার কাজটাকেই বেছে নিয়েছিল সে । সকালবেলা রেল কলোনির ষাটটি বাড়িতে পেপার দেয় সে, ষ্টেশনেও কিছু কাগজ বিক্রি হয় । তারপর পড়া করে স্কুলে যায় সে । বিকেলে স্কুল থেকে ফিরে মায়ের ভেজে প্যাকেট করে রাখা বাদাম, ছোলা এসব ফেরি করে প্ল্যাটফর্মে । ক্লাস টেনে ওঠার পর ফেরি করা ছেড়ে দিতে হল সুমন কে, শুধু সকালে পেপার বিক্রি করে সে । স্কুলের স্যারেরা বলেছিএন, “সুমন, খুব ভালো রেজাল্ট করতে হবে তোকে ।মা ঠোঙা বানাতো অনেক রাত জেগে, আর সুমন মার পাশে বসে পড়তো । বই খাতা কেনার অসামর্থ্যটা কয়েকজন স্যার আর বন্ধুরা টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে ঢেকে দিত সুমনের মেধা আর মিষ্টি ব্যবহারের জন্য । ইংরেজীর স্যার বাদলবাবু বলেছিলেন, “Do your best, forget your rest.”  কথাটা অক্ষরে অক্ষরে পালন করার চেষ্টা করে সুমন ।
কাল জন্মদিন ছিল বাবার । বছরের এই একটা দিনই খুশী আনে মা-ছেলের মনে । বাবার ছবিতে মালা দিয়ে সাজিয়ে ধূপ দেয় সুমন, মা পায়েস রান্না করে ।
এইসব পুরানো স্মৃতি ভাবতে ভাবতে রেললাইন ধরে হাঁটতে থাকে সুমন ।
হঠাৎ সুমন খেয়াল করলো ওপাশের রেললাইন ধরে একটা আবছা মূর্তি যেন এগিয়ে চলেছে। অন্ধকারে ঠিক বোঝা যায়না, কিন্তু একটা মেয়ে হবেই মনে হয়। আরে! ওই লাইন দিয়েই তো ট্রেন আসছে একটা! মেয়েটা কেন সেই লাইন দিয়েই এগিয়ে চলেছে? না, বেশি ভাবার সময় নেই, ট্রেন খুব কাছেই এসে পড়েছে। সুমন দৌড় লাগালো উল্টোদিকের লাইনের দিকে, এই যে এই যে... থামুন... সরে যান লাইন থেকে... বলতে বলতেই ঝাঁপিয়ে পড়ে ধাক্কা দিয়ে মেয়েটাকে নিয়ে পড়ে লাইনের ওপাশে খালের দিকে । কয়েক মিলিসেকেন্ডের মধ্যেই হুইসেল বাজিয়ে লাইন কাঁপিয়ে বেরিয়ে গেল দুরন্ত এক্সপ্রেস! লাইনের পাথরে হাতে চোট লেগেছে মনেহয়, খুব ব্যথা হচ্ছে । যাইহোক, মেয়েটা কে? কেনই বা ওভাবে লাইন ধরে হাঁটছিল? সুমনকে জড়িয়ে ফেলেছে মেয়েটা, ভয়েই হবে হয়তো বা ঘটনার আকস্মিকতায়... এই যে শুনছেন? না, সাড়া নেই মেয়েটির। মনে হয় অজ্ঞান হয়ে গেছে । তাড়াতাড়ি খাল থেকে একটু জল আনে সুমন, মেয়েটির চোখেমুখে ছিটিয়ে দেয়, হাল্কা কেঁপে ওঠে মেয়েটি। -এই যে শুনছেন?
এবার উঠে বসে মেয়েটি। ভোরের আলো একটু একটু করে ফুটছে । সুমন চিনতে পারলো মেয়েটি ষ্টেশনমাস্টার মল্লিকবাবুর মেয়ে শিখা । ওই কোয়ার্টারে পেপার দিতে গিয়ে অনেকবার দেখেছে মেয়েটিকে । নামটাও শোনা, কারণ ও সুমনের স্কুলেই পড়ে নিচের ক্লাসে । মাধ্যমিক দেবে তো মেয়েটি এবার, ক্লাসে ভালো রেজাল্টও করে শুনেছে... তবে কেন...!
ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে মেয়েটা, ফুলের পাঁপড়ির মত ঠোঁটটা বারবার কেঁপে কেঁপে যাচ্ছে । একি, শিখা তুমি? তুমি ওভাবে লাইন ধরে কেন হাঁটছিলে এখন? কি হয়েছে তোমার?
ফোঁপানো গলায় আওয়াজ আসে, “টেস্টে ভালো রেজাল্ট হয়নি আমার।
পুরো ব্যাপারটা বুঝতে পারে সুমন। ঠিক আছে শিখা তুমি বাড়ি চল এখন, আমি মল্লিকবাবুকে সব বুঝিয়ে বলবো পরে, মন দিয়ে পড়াশোনা কর। ওদের বাড়ির সামনে পর্যন্ত এগিয়ে দিতে যায় সুমন। যাও শিখা ঘরে যাও ।
-
একটা কথা ছিল।
-
হুম বলো।
-
বাবাকে এসব কিছু জানাবেনা প্লীজ।
-
আচ্ছা ঠিক আছে। বাড়ির দিকে পা চালালো সুমন।
হাতটা খুব ব্যথা করছে, ছড়ে গেছে অনেকটা। তাড়াতাড়ি বাড়ি গিয়ে ব্যান্ডেজ করতে হবে, তারপর আবার আসবে ষ্টেশনে। সুমনের মনে আছে, মাধ্যমিকের সময় ফর্ম ফিলাপের টাকা ছিলনা ওর, মল্লিকবাবুই দিয়েছিলেন টাকাটা।
বাড়িতে এসে দেখে মা নেই, কাজে বেরিয়ে গেছে মা। ডেটল দিয়ে ক্ষতটা পরিষ্কার করে জায়গাটা বেঁধে নেয় সুমন। দৌড় লাগায় জলদি, কাগজ এসে গেছে এতক্ষণে।
আজ মল্লিকবাবুর বাড়িতে সবশেষে কাগজ দিতে যাবে সুমন। একে একে সব বাড়ি প্রায় শেষ। সুমন অনেকবার দেখেছে শিখাকে, স্কুলে-বাড়িতে অনেকবার চোখাচোখিও হয়েছে। কিন্তু ব্যস্ত সুমন কখনওই বিশেষ কিছু ভাবার সময় পায়নি কোনও মেয়েকে নিয়ে। কিন্তু আজ শিখার স্পর্শ যেন আলাদা একটা অনুভূতি এনেছে সুমনের মনে... ভাবতে ভাবতেই মল্লিকবাবুর দরজায় কলিং বেল বাজিয়েছে সুমন। দরজা খুলে বেরোলেন মল্লিকবাবুই। পেপার দিতে গিয়ে হাতের চোটটা বেরিয়ে আসে।
একি, সুমন হাতে চোট লাগলো কি করে?
-
ও কিছুনা স্যার। লাইনে পড়ে গিয়ে ছড়ে গেছে একটু।
-
ভেতরে এসো সুমন। কথা আছে তোমার সাথে।
ভয়ে ভয়ে ভেতরে ঢুকল সুমন। একটা চেয়ার এগিয়ে দিলেন মল্লিকবাবু, বসো। শর্মিলা?
শিখা কে নিয়ে মল্লিকবাবুর স্ত্রী ঢুকলেন রুমে। সুমন লক্ষ্য করলো শিখার কপালে টেপ দিয়ে ব্যান্ডেজ করা।
শিখা সব বলেছে আমাদের। তুমি সত্যি খুব ভালোছেলে বাবা, ঠিক তোমার বাবার মতোই। আজ তোমার জন্যই আমার মেয়েকে ফেরত পেয়েছি। আমার একটা অনুরোধ রাখবে বাবা?-মল্লিকবাবু বললেন।
-
হ্যাঁ, স্যার বলুন।
-
তুমি এই তিন মাস শিখার পড়াশোনার দায়িত্ব নেবে বাবা? দেখো ও এতদিন একটা কোচিং এ পড়তে যেত। বখাটে পাল্লায় পড়ে টেস্টের রেজাল্ট ভালো হয়নি।
-
হ্যাঁ, স্যার আমি রাজি। শিখা খুব মেধাবী আমি জানি। ও পারবেই ।
-
ঠিক আছে বাবা, পারিশ্রমিকের ব্যাপারে কোনো চিন্তা করোনা...
-
কিন্তু আমার একটা শর্ত আছে স্যার। আমি কোনও পারিশ্রমিক নিতে পারবোনা।
একটু যেন বিস্মিত হলেন মল্লিকবাবু। কিন্তু তা কি করে হয় সুমন?তুমি আমার মেয়েকে পড়াবে, আর তাছাড়া তোমাদের খুব কষ্টের সংসার। তুমি কেন নেবেনা পারিশ্রমিক? একটু যেন কঠোরভাবে বললেন মল্লিকবাবু।
-
ঠিক আছে স্যার, আগে শিখার পরীক্ষা শেষ হতে দিন, তারপর নাহয় পারিশ্রমিক নেবো। চাপা গলায় মুখ নিচু করে বললো সুমন।
ঠিক আছে বাবা, খেয়ে নাও কিছু। কথার মাঝেই কখন যেন লুচি, ছোলার ডাল আর মিষ্টির প্লেট নিয়ে এসেছেন মল্লিকবাবুর স্ত্রী।
না না কাকিমা, এসবের কি দরকার? আমি খেয়ে এসেছি তো।
লজ্জার কিছু নেই সুমন। খেয়ে নাও, এখন থেকে তো তুমি শিখার শিক্ষক।
খাওয়া শেষ হতে সুমন উঠে দাঁড়ালো, এখন আসি তাহলে স্যার। একটু দাঁড়াও সুমন। ভেতরের ঘরে গেলেন মল্লিকবাবু। শিখা উল্টোদিকের চেয়ারটায় চুপ করে বসে আছে। হঠাৎ নিচুস্বরে জিজ্ঞেস করলো- তুমি তবে কবে থেকে আসছো সুমনদা?”
-
আজ সন্ধ্যেতেই আসবো শিখা।
এই নাও সুমন এটা দিয়ে হাতের ডাক্তার দেখিও, একটা পাঁচশো টাকার নোট হাতে নিয়ে ঢুকলেন মল্লিকবাবু।
-
না না স্যার, এসব লাগবেনা। আমার হাত ঠিক আছে। ডাক্তার দেখানো লাগবেনা।
-
হাতের জন্য ডাক্তার দেখিও সুমনদা, শিখা বললো।
চুপচাপ মুখ নিচু করে টাকাটা নিয়ে বেরিয়ে এল সুমন।
সেদিন থেকে একটা দায়িত্ব বেড়ে গেল সুমনের। উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে দুবছর বেকার হয়ে বসে ছিল সে। সকালে কাগজ ফেরি আর তারপর ছোলা-বাদামের প্যাকেট বিক্রি করে মা-কে সংসার চালাতে সাহায্য করে আসছিল সে এতদিন। আজ যেন জীবনে এক বসন্তের আগমন ঘটেছে তার। সকালে কাগজ দিয়ে এসেই চলে যায় শিখা কে পড়াতে। আবার সারাদিন অক্লান্ত পরিশ্রম করেও সন্ধ্যায় সে সোজা ঠিক হাজির হয়ে যায় পড়াতে। শিখাও আগ্রহের সঙ্গেই পড়াশোনা করে। মল্লিকবাবু মাঝে মাঝেই লক্ষ্য করতেন সুমনের পড়ানো আর নিজেই তাজ্জব হয়ে যেতেন- খুব কঠিন কঠিন বিষয়ও এত সহজভাবে বোঝাতে পারে সুমন...!
মাধ্যমিকে সব বিষয়ে লেটার নিয়ে স্কুলের মধ্যে প্রথম হল শিখা। মল্লিকবাবু খুব স্নেহ করেন সুমনকে। অনেকটা জোর করেই সুমন কে কলেজে ভর্ত্তি করে দিয়েছেন তিনি। সুমন এখন ফিজিক্স অনার্স নিয়ে পড়ে, পড়ার সব খরচই মল্লিকবাবু দেন। সাথে প্রায় সমস্ত রেল অফিসারদের ছেলেমেয়েদের পড়ানোর দায়িত্ব সুমনের উপরে। কিন্তু সবার মাঝে সুমনের সবচেয়ে বেশি পড়ানোর আগ্রহ থাকে শিখা কে, শিখা এখন ক্লাস ইলেভেনে পড়ে বিজ্ঞান নিয়ে।
পেপারওয়ালা সুমন আজ রেল কলোনির সুমন-মাস্টার। কিন্তু সকালে এখনও সে পেপার দেয় আগের মতোই। শুধু এখন আর ছোলা-বাদাম বিক্রি করেনা সে। মা কেও আর কাজ করতে যেতে দেয়না। কোনওকাজই করতে দিতে চায়না সে মা কে। কিন্তু মা কথা শোনেন না, বাড়ির কাজ ছাড়াও সারাদিন বসে ঠোঙা বানান মা। নিজের জন্য সামান্য কিছু হাতখরচ রেখে বাকি সব টাকাই মায়ের হাতে তুলে দেয় সুমন। এখন ওদের অবস্থা আগের মত অসহায় নয়। মল্লিকবাবু, মল্লিকবাবুর স্ত্রী খুব ভালোবাসেন সুমনকে। শিখারও খুব কাছের হয়ে উঠেছে সুমন। সুমনকে ছাড়া যেন তার চলেইনা তার একরকম। সুমনেরও শিখা কে পড়াতে যাওয়ার জন্য মন ছটফট করে। তাছাড়া শিখার নানা আবদারও এখন মেটাতে হয় সুমনকে। তবে কেউই কাউকে মনের কথাটা বলে উঠতে পারেনি সাহস করে। মল্লিকবাবু বা তাঁর স্ত্রী-ও ওদের সম্পর্কটাকে খারাপ চোখে দেখেননি কখনও, তাই ওদের মেলামেশায় কোনও বাধাও ছিলনা।
সেদিন, শিখার মা-বাবা কেউ বাড়িতে নেই। মল্লিকবাবুকে অফিসের কাজে বাইরে যেতে হয়েছে আর শিখার মা গেছেন শিখার মাসির বাড়ি, যদিও তিনি ফিরে আসবেন রাতেই। সুমন পড়াতে এসেছে শিখা কে। বাইরে গুমোট মেঘ, বৃষ্টি আসবে বোধহয়। আজ লাল রঙের একটা চুড়িদার পরে পড়তে বসেছে শিখা, খুব দারুণ লাগছে আজ শিখাকে। পড়াতে পড়াতেই শিখার দিকে তাকিয়ে বারবার হারিয়ে যাচ্ছে সুমন, ঠিক যেন একটা জীবন্ত লাল কৃষ্ণচূড়া তাঁর সামনে... না না, ঠিক যেন একটা লালপরী। হঠাৎ মেঘ গুড়গুড় করতে করতে বৃষ্টি নামলো। শিখা উঠে গিয়ে দরজা জানলা সব বন্ধ করে আবার বসলো পড়তে। মেঘের গুড়গুড় শব্দে শিখা বারবার কেঁপে কেঁপে উঠছে। সুমন জানে বাজের শব্দে ভয় প্য শিখা। বললো মনে হয় কারেন্ট চলে যাবে এবার, তুমি চার্জার লাইটটা নিয়ে এসে বসো। শিখা সবে উঠেছে আর দড়াম করেই কাছে কোথাও বাজ পড়লো আর কারেন্ট গেল চলে। ভয়ে চিৎকার করে শিখা ঝাঁপিয়ে পড়লো সুমনের বুকে, শক্ত করে জাপটে ধরল তাকে। সুমনও চেষ্টা করলোনা ছাড়াবার। আমি তোমাকে ভালোবাসি সুমন, বাঁচবোনা তোমায় ছাড়া”-শিখা বললো। আমিও তোমায় ভালোবাসি শিখা, আমার পক্ষেও অসম্ভব তোমায় ছেড়ে বাঁচা”-সুমন বললো। এক না বলা সম্পর্ক যেন প্রকৃতির অন্ধকারের খেলায় বাস্তবতায় রূপ পেল। সুমন বুঝলো, তার বুকে শিখার তপ্ত নিঃশ্বাস সারা শরীরে নেশার আগুন জাগাচ্ছে, কোথাও হারিয়ে যাচ্ছে যেন দুজনেই। ধীরে ধীরে দুজনের ঠোঁট যখন এক হয়ে প্রেমের বৃষ্টিতে ভিজতে যাচ্ছে, তখনই কারেন্ট চলে এল। চকিতে সম্বিৎ ফিরল সুমনেরও, ছিটকে সরে গেল সে শিখার থেকে। মাটির দিকে তাকিয়ে লজ্জায় লাল হয়ে যাওয়া দুটি মুখ একে অপরের দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারছেনা আর। এমন সময় দরজায় কলিং বেলের শব্দ হল। শিখা গিয়ে দরজা খুলে দিল, তার মা ঢুকলেন ঘরে।
সুমন তুমি এসেছো? যাক ভালোই হয়েছে। জানোই তো শিখা খুব ভয় পায়- শিখার মা বলে উঠলেন।
হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে সুমন বলে উঠলো- কাকিমা আজ চলি, মায়ের একটু শরীর খারাপ। তাড়াতাড়ি চলে গেল সুমন আজ।
সেদিন রাতে দুটি বিছানায় দুটি মন রাত জেগে রইলো, ঘুম আসলনা কারুরই চোখে।
পরেরদিন ছিল সুমনের বাবার জন্মদিন। কিন্তু আজ আনন্দটা যেন অনেকটাই ফিকে। সুমনের মায়ের শরীর খারাপ খুব। রাত্রে সুমনের মা সুমনকে ডেকে বললেন- আমি তোকে একটা জিনিস এতদিন দেখাইনি। এই নে এই আংটি তোর বাবার পরিচয়, তোর উত্তরাধিকার। সুমন আংটিটা হাতে নিয়ে দেখলো- নীলরঙা মুক্তোর বলয়ের মাঝে মাঝে ছোট্ট একটা হীরে “S” আকারের ।
কিছুদিন পরে সুমন আর শিখা দুজনে মিলে বসে আছে একটা পার্কের নিরিবিলিতে। পার্ক তখন বেশ ফাঁকা। সুমনের কোলে মাথা রেখে শিখা বলে ওঠে- সুমন তুমি আমায় বিয়ে করবে তো?
-
অবশ্যই, সুমন বলে। কিন্তু আমি আগে নিজের পায়ে দাঁড়াই, নাহলে তোমাকে রাখবো কোথায়?
-
সুমন, আমার বাবা-মা যদি মেনে না নেয়?
-
ওসব তখন ভাবা যাবে, এখন ওসব নিয়ে ভাব্লে চলে?
তারপর কেটে গেছে দুটি বছর। সুমনের এটা ফাইন্যাল ইয়ার, এখনও চাকরী পায়নি সে। এখনও পেপার বিক্রি আর টিউশান পড়িয়েই তাঁর দিন চলে । এদিকে শিখার বাবা মা ওদের সম্পর্কের কথা জেনে গেছেন এতদিনে। বাধ্য হয়ে মেয়ের বিয়ে ঠিক করেছেন মল্লিকবাবু, নিজের এক সহকর্মীর ছেলের সঙ্গে।
-
বাবা, আমি সুমনকে ছাড়া কাউকে বিয়ে করতে পারবোনা।
-
তা হয়না মা। আমি জানি সুমন খুব ভালো ছেলে। কিন্তু আমাদের স্ট্যাটাসের সাথে ওদের ঠিক খাপ খায়না। লোকে কি বলবে আমায়? একজন পেপারওয়ালা আমার জামাই? নিজের মানসম্মান মেয়ের ভালোবাসার চেয়ে বড় নয় মল্লিকবাবুর কাছে। বিবেকের সাথে যুদ্ধে সমাজ তাই তাঁকে হারিয়ে দিয়েছে। কিন্তু একটা কষ্ট তাঁরও হচ্ছে। মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে চোখে জল চলে এল মল্লিকবাবুর। বাবার কান্নার কাছে হেরে গিয়ে চুপ করে যায় শিখাও।
আর দুদিন পরে শিখার বিয়ে। আজ সে চেয়েছে সুমনের সাথে দেখা করতে। অনেকক্ষণ ধরেই পার্কে অপেক্ষা করে আছে শিখা। কিন্তু সুমন কোথায়? এমন তো কোনদিনও করেনা সুমন... দুঘণ্টা হয়ে গেল, এখনও আসলনা সুমন! হয়তো শিখার ভবিষ্যতের কথা ভেবেই আর শিখার সামনে আসবেনা সে... শিখার সামনে দুনিয়াটা বনবন করে ঘুরতে থাকে, কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরে যায় সে।
এদিকে সুমন তখন হাসপাতালে বসে মায়ের জন্য প্রার্থনা করে চলেছে। সকাল থেকেই খুব বাড়াবাড়ি হয়েছে মায়ের। শ্বাসকষ্ট, প্রবল কাশি আর জ্বর মায়ের। মাকে ছেড়ে কোথাও যাবেনা সে। শিখার মুখটা মনে আসে। এতক্ষণ অপেক্ষা করে সে নিশ্চয়ই ফিরে গেছে। বুকটা ফেটে যেতে থাকে তার।
আজ শিখার বিয়ে। এত হুল্লোড়ের মাঝেও শিখা খুঁজে চলেছে তার চেনা সুমনকে। বিশ্বাস নিয়ে বসে আছে সুমন এসে তাকে নিয়ে যাবেই। কিন্তু না, বিয়ের লগ্ন এসে গেলেও সুমন এলনা আর। বিয়ের পিঁড়িতে বসে ফোঁপাতে থাকে শিখা। সুমন পারলো তাকে ছেড়ে যেতে! কিন্তু সে কি করে জানবে আজ সব কিছুই হারিয়ে শ্মশানে মায়ের চিতায় আগুন দিচ্ছে তার সুমন...!

সুমন এখন নিঃসঙ্গ, তার পাশে কেউ নেই অর্ধেকদিন তিনবেলা না খেয়েই পড়ে থাকে চুপ করে সকালে ষ্টেশনে কিছু পেপার বিক্রি করে আর বাড়ির বাইরে বের হয়না ভাবতে থাকে অতীত, স্মৃতিগুলো তাড়া করে বেড়ায় খালি টিউশন পড়াতেও যায়না, আর রেলবাবুদের কোয়ার্টারেও পেপার দিতে যায়না কিছুটা খারাপ লাগা আর কিছুটা লজ্জায় কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলেই বলে একাই তো থাকি, কিই বা আর খরচ…”
ওদিকে শিখাও সুখী হয়নি শ্বশুরবাড়িতে সবসময় একা একা থাকে, ঠিকমত খাওয়াদাওয়া করেনা, কারুর সাথে কথাও বলতে চায়না শিখার স্বামি অর্জুন অনেকবার জিজ্ঞেস করেও কোনও উত্তর পায়নি শিখার থেকে বাধ্য হয়ে সেও হাল ছেড়ে দিয়েছে
কিন্তু উপরওয়ালা বোধহয় আলাদা কিছু ভাবে শিখা, শিখার শাশুড়ি, আর শিখার বর অর্জুন আসছে শিখার বাবার কাছে সেদিন সুমনেরও মন খারাপ খুব, বেলা প্রায় দশটা বেজে গেলেও সে না বিক্রি হওয়া কিছু পেপার নিয়ে চুপ করে বসে আছে প্ল্যাটফর্মের বেঞ্চটায় একটার পর একটা ট্রেন আসছে যাচ্ছে, লোকজনের ওঠানামা চুপ করে বসে এসবই দেখছে সে আর আনমনে পুরানো স্মৃতিগুলো মনের মধ্যে ভেসে যাচ্ছে হঠাৎ একটা ট্রেন থামে সামনে, আর তারপর যাকে দেখে সুমন তা তার কল্পনারও বাইরে। শিখা! ট্রেন থেকে নেমে আসতে আসতে শিখারও চোখ পড়েছে সুমনের অবাক দুচোখে। সুমন সরে যেতে চায় উঠে, কিন্তু সামনেই একজন পেপারয়ালাকে দেখে শিখার শাশুড়ি এগিয়ে আসে একটা আনন্দবাজার দাও দেখি।সুমন একটা আনন্দবাজার বের করে, মানিব্যাগ থেকে টাকা বের করে পেপারের দাম গিতে গিয়ে চমকে ওঠেন শিখার শাশুড়ি গীতাদেবী। -এই যে শোনো, এই আংটি তুমি কোথায় পেলে?
-আমার মা দিয়েছেন, আমার বাবার স্মৃতি এটা। সুমন খেয়াল করলো ভদ্রমহিলার হাতেও ঠিক একইরকম একটা আংটি, যেটা সুমনকে মা দিয়ে গিয়েছিল বাবার শেষ স্মৃতি হিসেবে।
-তোমার মা দিয়েছেন! নাম কি তোমার? তোমার বাবা?
-আমার নাম সুমন। বাবা মারা গেছেন, ঈশ্বর সুভাষ রায়।
গীতাদেবী জড়িয়ে ধরলেন সুমনকে, তাঁর চোখ দিয়ে বাঁধভাঙা জল ঝরেই চলেছে... তুমি আমার দাদার ছেলে হয়ে আজ ষ্টেশনের পেপারয়ালা সুমন! তারপর সুমনের মুখেই শুনলেন নিজের দাদার জীবনকাহিনী, সুমনের মায়ের মারা যাওয়ার কথা। অনেকদিন পরে নিজের বংশের প্রকৃত উত্তরাধিকারীকে পেয়ে শত দুঃখের মাঝেও গীতাদেবী আজ খুব খুশি, নিজের হারানো দাদার ছেলেকে খুঁজে পেয়েছেন যে! অর্জুন আর শিখাকে ডেকে সুমনের সাথে আলাপ করালেন গীতাদেবী, “আমার দাদার ছেলে সুমন।হাঁ করে সুমনের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল শিখা। সুমনকে সাথে করে নিয়েই শিখার বাবার কাছে মানে মল্লিকবাবুর বাড়িতে গেলেন গীতাদেবী। সুমন যেতে চায়নি, কিন্তু গীতাদেবী আর হারাতে চাননা নিজের বাবার উত্তরাধিকারীকে। সুমনকে দেখে চমকে উঠলেন মল্লিকবাবু, কিন্তু সব শুনে চুপ করেই থাকলেন।
শিখা খুব চঞ্চল হয়ে উঠেছে সুমনকে দেখার পর। সুমন এখন তাদের পরিবারেরই একজন সদস্য হয়ে ওঠার পর যেন সব খুশি আবার ফিরে এসেছে শিখার জীবনে। গীতাদেবী নিজের বাবার সব সম্পত্তি লিখে দিয়েছেন সুমনের নামে। সুমনের অনুরোধে গীতাদেবী কিছুদিনের জন্য থেকে গেলেন সুমনের দাদুর বাড়িতে, যেটা এখন সুমনের নামে সাথে সাথে শিখা আর অর্জুনও থেকে গেল। শিখা থাকায় সুমনও খুব খুশি হল। কিন্তু শিখা সুমনকে ফিরে পাওয়ার জন্য ছটফট করছে, সেটা সুমন বুঝতে পারে। এই নিয়ে শিখা আর অর্জুনের মধ্যে সম্পর্ক প্রায় তলানিতে। সুমন আজ নিজের পারিবারিক সূত্রে পাওয়া অগাধ সম্পত্তির মালিক। একটা বড় বাড়ি থেকে অগাধ টাকাকড়ি, কি নেই তার! একটা অপরাধবোধ কাজ করে সুমনের মধ্যে। সুমন আজও ভালোবাসে শিখাকে, কিন্তু তার জন্য সে শিখার জীবনে ঝড় হয়ে উঠতে পারবেনা কখনওই। শিখার সংসার এখন তো সুমনেরও পরিবারের অঙ্গ, কি করে ভাঙবে সুমন এই সংসারকে? অনেক রাত পর্যন্ত ভাবলো সুমন।
পরেরদিন সুমন গেল উকিলের কাছে। বাড়িটা লিখে দিল শিখার নামে, আর ব্যাঙ্কের সমস্ত টাকা অর্জুন আর শিখাকে ভাগ করে উইল করে দিল সে। সেদিন সারারাত ঘুমালোনা আর সুমন। দুখানা চিঠি লিখলো, একটা নিজের পিসি গীতাদেবীকে আর একটা শিখা কে উদ্দেশ্য করে। বাবার কিছু স্মৃতি এবাড়িতে আসার পর থেকেই নিজের কাছে গুছিয়ে রেখেছিল, আর কিছু প্রয়োজনীয় টাকাপয়সা নিয়ে বেরিয়ে পড়লো ঘর থেকে। রাত খুব গভীর, সবাই ঘুমাচ্ছে। আজ মনভরে শিখার ঘুমন্ত মুখটা দেখে নেবে সুমন। চুপিচুপি এল শিখার ঘরে। শিখা আর অর্জুন শুয়ে আছে পাশাপাশি, সত্যিই যেন জন্মজন্মান্তরের জুড়ি ওরা। আস্তে করে শিখার আঁচলে চিঠিটা বেঁধে দিল সুমন। মাথায় একবার হাত বুলিয়ে দিতে ইচ্ছে হল খুবনা, শিখা অন্য একজনের স্ত্রী, তাকে কি করে ছোঁবে সুমন! চুপচাপ বেরিয়ে এল ঘর থেকে, জানলার বাইরে থেকে মনে মনে বলে দিল তার প্রিয়তমাকে, “সুখী হও শিখা।পিসির ঘরে এল সুমন, অঘোরে ঘুমোচ্ছে পিসি। চুপিচুপি গীতাদেবীর মাথার কাছে রেখে এল চিঠিটা। আমায় ক্ষমা কর পিসি
সকালবেলা সুমনকে কোথাও পাওয়া গেলনা আর। গীতাদেবী কেঁদেই চলেছেন, শিখা প্রায় পাগলের মত হয়ে গেছে, অর্জুন চুপ করে বসে আছে। বেলার দিকে একটু শান্ত হয়ে গীতাদেবী নিজের ঘরে গেলেন, তখনই নজরে পড়লো চিঠিটা। কাঁপাকাঁপা হাতে চিঠিটা খুললেন তিনি-
প্রিয় পিসি,
    তুমি আমাকে অনেক ভালোবাসো জানি। ভাবতেও পারিনি যে পৃথিবীতে মা ছাড়াও মায়ের মত কেউ আছে। তুমি আমার জন্য যা কিছু করেছো, তা আমার জন্য অনেক। কিন্তু পিসি, আমি ছোটো থেকেই অনেক অভাবের মধ্যে বড় হয়েছি, তাই চলে যাচ্ছি আমার ঠিকানায়, অনেক দূরে। অর্জুনকে আমি নিজের ভাইয়ের মতোই ভালোবাসি। কিন্তু একজন পেপারওয়ালা হয়ে অর্জুনের মামার ছেলে হওয়ার যোগ্যতা আমার নেই। বাবা বেঁচে থাকলে হয়তো ওদের বিয়েতে অনেককিছু দিতেন। আজ বাবার হয়ে আমিই ক্ষুদ্র একটা উপহার দিয়ে গেলাম। তুমি আমায় ভুল বোঝোনা পিসি। আমার উপহারটা ওদের নিতে বলো আর সুখী হতে বলো। আমার প্রণাম নিও, আর পারলে ক্ষমা করো।
                                                   ইতি,
                                               তোমার সুমন
গীতাদেবী চিঠিটা পড়ে স্থবিরের মত দাঁড়িয়ে রইলেন। অনেকক্ষণ পর চোখের জল মুছে মুচকি হেসে বললেন, “ঠিক ওর বাবার মতোই হয়েছে।
এখন শিখা টের পেল ওর আঁচলে কিছু একটা বাঁধা রয়েছে। চটপট সে আঁচল খুলে চিঠিটা পেল।
শিখা,
আমি তোমার মনের কথা বুঝতে পারেছি। কিন্তু তুমি এখন আমার ভাইয়ের স্ত্রী। তোমার মনে আছে শিখা, তোমাকে আমি ট্রেনলাইনে বাঁচিয়েছিলাম? কিন্তু তখন আমি প্রতিদান কিছু চাইনি। তুমি আমার মত একজন পেপারওয়ালাকে ভালোবেসেছো, এজন্য আমি গর্বিত। অর্জুন খুব ভালো ছেলে শিখা, তোমার ভাগ্য খুব ভালো যে তুমি তাকে নিজের স্বামি করে পেয়েছ। আমার পিসির ছেলে বলে নয় শিখা, অর্জুন তোমাকে খুব ভালোবাসে। যদি তুমি আমাকে সত্যিই ভালোবেসে থাকো, তবে আজ আমার ভালোবাসার প্রতিদান আমি নেবো। তুমি অর্জুনকে নিজের স্বামি হিসেবে পুরোপুরি মন থেকে গ্রহণ করবে, তাকে ভালোবাসবে, তার যোগ্য স্ত্রী হয়ে উঠবে। আমার কথা আর কখনও ভাববেনা। আমি তোমার সুখের সংসারে ভাঙন ধরাতে চাইনা বলেই আজ সরে গেলাম। যদি তুমি আমার এই কথাগুলো না মানো তবে বুঝে নিও তোমার সুমন মাস্টারকে তুমি কোনোদিনই ভালোবাসোনি। মায়ের কাজের জন্য তোমার বিয়ের আগে দেখা করতে পারিনি। তাই আজ যে উপহারটা দিয়ে গেলাম গ্রহণ করো পারলে। তোমার স্মৃতি হিসেবে তোমার রুমালটা চুরি করে এনেছি। আর কোনোদিনই আমাদের দেখা বা কথা হবেনা, এটাই শেষ চিঠি আমার। আমাকে দেখে তোমার বাবাও চিন্তায় পড়ে গেছিলেন, তিনি আমার জন্য অনেক কিছু করেছেন, আমি তাঁকে ঠকাইনি। আমি তোমায় নিজের করে পাইনি, কিন্তু তোমায় ভালোবাসবো সারাজীবন ধরে, কিন্তু দূর থেকে। শিখা কখনও মন খারাপ করবেনা বা জীবনের কোনও পরিস্থিতিতেই ভেঙে পড়বেনা। নিজের খেয়াল রেখো, ভালো থেকো, সুখী হও শিখা। চিঠিটা ছিঁড়ে দিও আর পারলে আমায় ক্ষমা করো।
                                                    ইতি,
                                                তোমার সুমন

শিখা যখন সুমনের চিঠিটা শেষ করে ভেসে যাচ্ছে চোখের জলে, সুমন তখন জীবনের রেলগাড়িতে করে অন্য এক ষ্টেশনের গন্তব্যে এগিয়ে চলেছে, তার কাছে পৌঁছোচ্ছেনা শিখার চোখের জল… (সমাপ্ত)

No comments:

Post a Comment

মনের কথা-Moner Katha