Saturday 9 July 2016


পিছুডাক
-দোয়েল 


আমি তখন ক্লাস টেনের মাধ্যমিক দিয়েছি সবে।পড়াশুনার চাপ না থাকায় প্রায়ই বন্ধুদের সাথে ঘুরতে বেরোতাম বিকেল বেলা। প্রতি দিন সাড়ে পাঁচটার মধ্যেই বাড়ি ফিরে আসতাম। মাঝে বেশ কয়েকদিন দিন জ্বর থাকায় বেরোইনি। জ্বর ঠিক হলে অনেকদিন পরে একদিন ঘুরতে বেরোলাম। অনেকদিন পরে যাওয়ায় বন্ধুরা কেউ সহজে আসতে দিলনা, অনেকক্ষণ ঘুরে আড্ডা হল সেদিন। সাড়ে ছয়টা বেজে যায় বাড়ি তখনও ঢুকিনি,  রাস্তায় হাঁটছি। গরমের সময়। আকাশে হঠাৎ কালবৈশাখীর কালো মেঘ ছেয়ে গেল। আমাদের বাড়ির রাস্তাটা বড়োই নির্জন তার ওপর তিন দিন আগে একজন সুইসাইড করেছে। মেয়েটি পড়তো আমারই সাথে। মাধ্যমিক দেওয়ার পরেই বাড়ি থেকে বিয়ে দিয়ে দিতে চেয়েছিল। মেয়েটি রাজি ছিলোনা ওই বিয়েতে। মেয়েটি সুইসাইড করার পরে তার বাড়ির লোককে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে... সেসব ভাবতে ভাবতেই আনমনে হাঁটছিলাম, গলির মুখে এসে গা টা কেমন যেন ছমছম করতে লাগলো। হঠাৎ হাওয়া উঠলো, ঝড়ো হাওয়া। সাথে সাথে লোডশেডিং! ঝুপ করে যেন গাড় অন্ধকারে হারিয়ে গেল সবকিছু। চেনা পথ তখন অচেনা আমার কাছে। হাতড়ে হাতড়ে কোনও মতে এগিয়ে চলেছি। শোঁ শোঁ শব্দে হাওয়া বয়েই চলেছে, হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হল। ভিজতে ভিজতে পথ হাতড়ে হাতড়ে এগোতে লাগলাম ভয়ে ভয়ে। মা বরাবর বলতো মেয়ে হয়ে সন্ধ্যায় চুল খুলে বেরোতে নেই! বেরোলেই নাকি ভূতে পায়, হাওয়া লাগে,  অপ-অশরীরীদের দৃষ্টি পড়ে। কিন্তু আধুনিক জুগের মেয়ে হয়ে আমি ওসব মানতাম না।  ধূর ছাই বলে চুলটা ছেড়েই বেরিয়েছিলাম। সেদিন আবার ছিল শনিবার। এত সত সুপারস্টিশন কোনটা ছাড়িয়ে কোনটা ধরি! যাইহোক এখন এই পরিস্থিতিতে সব আধুনিকতা উবে গিয়ে ভয় চুপসে গেছি পুরো। ভয়ে জড়সড়ভাবে এগোতে লাগলাম অলিগলির ভেতর..। হঠাৎ মনে হল পেছন থেকে কে যেন আমার ডাক নাম ধরে ডাকছে!  গলাটা চেনা চেনা লাগলো যেন, যদিও পুরো ডাকটা শুনিনি। তাও মনে হল যেন মা ডাকছে আমায়। পেছন ঘুরে মা বলে ডাকলাম। কিন্তু মা বলে, পেছন ঘুরে দেখতে নই কখনও। কোনও সাড়া এলনা আর। মনে হল পেছন থেকে যে আমায় ডেকেছিল সে আমার প্রত্যুত্তর শুনতে পায়নি। একটু দাঁড়িয়ে গেলাম, যে ডেকেছিল সে যেই হোক পেছন থেকে আসবে... হঠাৎ খেয়াল হল এই গাড় অন্ধকারের মধ্যে আমায় দেখতে পেলই বা কে! আর কেই বা ডাকবে এখন এভাবে! টের পেলাম বৃষ্টির জলের সাথে সাথে আমার শিরদাঁড়া দিয়ে ঠাণ্ডা স্রোতও বয়ে চলেছে। হঠাৎ একটা ঝলকানি দিয়ে বিকট শব্দ করে কাছেই কোথাও বাজ পড়লো। বিদ্যুতের ঝলকানির সে অস্পষ্ট আলোয় দেখলাম, ওই বাড়িটার সামনেই দাঁড়িয়ে আছি আমি যেখানে মেয়েটা সুইসাইড করেছিল! আশেপাশে কেউ কোথাও নেই ওখানে। কি হল তবে? আমার নাম ধরে তবে যে ডেকেছিল সে গেল কোথায়! গলার আওয়াজ টা তবে কার?  এসব ভাবতে ভাবতেই বুঝলাম প্রবল বাতাসেও খুব ঘাম দিচ্ছে। আবার একবার বিদ্যুতের ঝলকানি যেন আমার রক্ত হিম করিয়ে দিল। দেখলাম সেই বাড়ির বারান্দায় গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে আছে সেই মেয়েটি, যে কয়েকদিন আগেই হারিয়ে গেছে পৃথিবীর থেকে... কিভাবে যে এক দৌড়ে বাড়ি পৌঁছেছিলাম নিজেও জানিনা। শুধু এটুকুই মনে আছে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাওয়ার আগে মা আমার হাতটা ধরে ফেলেছিল।

No comments:

Post a Comment

মনের কথা-Moner Katha