Monday 4 July 2016

"শূন্য থেকে শুরু"
-সৃজন সাহা (Srijan Saha)


--আরে অ গোপাল দা..... দুটো হালকা লিকার..!!
উফ সালা....!! আজও ঢালবে মনে হচ্ছে বুঝলি রাজা। 
রাজাঃ হুঁ..!! তা আর বলতে...
আমি (খবরের কাগজটায় চোখ বোলাতে বোলাতে)ঃ 'ত্রিকোণ প্রেম' হাহ! কি দিনকাল পড়লো রে ভাই। ছেলেটা দুটো সম্পর্কে জড়িয়ে গেছিলো। তারপর ভুল বোঝাবুঝি। রক্তারক্তি কাণ্ড। খালের ধারে মেয়েটার বডি পাওয়া গেছে। কি লাভ হয় এসব করে? তিনটে জীবন নষ্ট... চা টা ফাটাফাটি হয়েছে গোপাল দা!!
রাজাঃ অভি....

-- উঁ
রাজাঃ ভাই তোকে না একটা কথা......
--অভিষেক দা একটু শুনবে?
-- হুঁ? কে? এ কিরে নীলা, তুই? কি ব্যাপার??
নীলাঃ না মানে... ইয়ে..
--কিছু বলবি??
নীলাঃ বিকেলে একটু সময় দিতে পারবে?? কথা আছে।
--আচ্ছা! বেশ...
রাজাঃ (নীলার ফিরে যাওয়াটুকু দেখতে দেখতে) কি গুরু? বিকেলে? দ্যাখা হবে? কথা হবে??? ডুবে ডুবে জল খাচ্ছ মামা??
--হুট শালা!! যত ফালতু কথা তোর....
গোপালদা দুটো লিকার কাটো (একটা দশ টাকার নোট এগিয়ে দিলাম)
বাড়ি এসে চুপচাপ জানলার ধারে বসে অস্থির ভাবে সেই সব কথাগুলোর কাঁটাছেঁড়া করতে লাগলাম। নীলাকে প্রথমবার যেদিন দেখি সেই দিনটা মনে পড়ে গ্যালো। ক্লাস ১১ তখন। প্রতিবারের মত সেবারও আমি, রাজা আর অণির্বান কৌশিকদের বাড়ীতে নিমন্ত্রিত, উপলক্ষ লক্ষ্মী পূজা। আসলে নেমন্তন্ন না থাকলেও আমরা কৌশিকের বাড়ীতে হামলা করতাম, কারণ কাকিমার হাতের খিচুড়ি, ওরম এ-ক্লাস খিচুড়ির জন্যই আমার মতে কাকিমার একটা পদ্মশ্রী বা ভূষণ কিছু একটা পাওয়া উচিত। মানে আহারই তো উৎসবের ভূষণ। যাই হোক, ফালতু এসব বলে আপনাদের বোর করবো না, আসল গল্পে আসা যাক, মানে নীলা-দর্শন। সেইবার প্রথম গিয়ে জানলাম কৌশিকের এক পিস্‌ মামাতো বোন আছে, ক্লাস নাইনে উঠেছে। মানে কী আর বলবো, ভগবান বোধয় এক পো সুচিত্রা-দু চা চামচ মাধুরী আর এক বাটি রেখা দিয়ে এই মেয়েকে গড়েছিলেন। মোদ্দা ব্যাপার হল প্রথম দর্শনেই দর্শক ক্লিন বোল্ড। আমি নেহাৎই নরাধম (বাবার মতে), অতএব বুঝে দেখুন আমার কী হাল...!! যাই হোক, মোটামুটি যা জানলাম তা হলো ইনি আপাততঃ এখানেই থাকবেন। সদ্য এইট পাশ করে, আমাদের এখানকার স্প্রিঙ্গেল গার্লস হাই স্কুলে ভর্তি হয়েছেন ক্লাস নাইনে। ইচ্ছে মামা বাড়ীতে থেকেই কলেজের গন্ডী টপকানোর। অর্থাৎ আমার হাতে বিস্তর সময় (তবে ঢিলে দিলে চলবে না), কাজে লেগে পড়তে হবে। নাহ্‌, এবার থেকে কৌশিকের কাছে একটু বেশীই আসতে হবে অর্গ্যানিক কেমিস্ট্রিটা নিয়ে, মানে বুঝলেও আসতে হবে, কথাতেই বলে প্র্যাকটিস মেকস্‌ আ ম্যান পার্ফেক্ট, অতএব.........
--বলি এটা তো ভদ্রলোকের বাড়ী নাকী? সারাদিন টইটই, পড়াশোনার নাম নেই, দয়া করে স্নান-খাওয়া করে আমায় উদ্ধার করো! আমিও তো একটা মানুষ.....
(তাল কাটলো মায়ের ধাতানিতে)
--উফ্‌!! যাচ্ছি....সবে তো দেড়টা বাজে।
আচ্ছা পাঠক, বুঝতেই পারছেন এবার আমায় উঠতে হবে, ততক্ষণে বাকীরা কী করছে একটু চট করে দেখে আসুন তো!
#নীলা
"আমার একলা আকাশ থমকে গ্যাছে
রাতের স্রোতে ভেসে
শুধু তোমায় ভালোবেসে....
আমার দিনগুলো সব রঙ চিনেছে
তোমার কাছে এসে
শুধু তোমায় ভালোবেসে......”
গানের প্রতিটা লাইনে নীলা মিশে যাচ্ছিলো, টের পাচ্ছিলো নিজের গলতে থাকা অস্তিত্ব। আচ্ছা ও এতদিন ধরে আসছে এ বাড়ীতে, দাদার সাথে এত কথা বলে, মজা করে, অথচ আমার চোখ পড়তে পারেনা ক্যানো? ভীতু না ক্যাবলা কে জানে। পড়াশোনায় তো মাথা আছে, অথচ একটা মেয়ের সামনে বাবুর জারিজুরি শেষ। তুত!! ভাল্লাগেনা।সেদিন রাস্তায় আমাকে দেখেও মুখ ফিরিয়ে অন্য দিকে হাঁটা দিলো। ক্যানো? আমি বাঘ না ভাল্লুক যে ওনাকে গিলে নেবো!! কী হতো,যদি আমার সাথে একটু দাঁড়িয়ে কথা বলতো? "পাতলা দাড়ি-নীল পাঞ্জাবী আর জিন্সে দারুণ লাগছিলো তোমায়” কথাটা নিজের মনে বলেই নীলা ফিক করে হেসে ফ্যালে। নাহ্‌! বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। যদি এসব কিছুই না হয়, সবটাই যদি নীলার ভুল ধারণা হয়, তালে দা'ভাই-এর কাছে ও খুব ছোট হয়ে যাবে। আফটারঅল দা'ভাই-এর ছোট্টবেলার বন্ধু ও। না না, আর এসব ভাববে না। আর তাছাড়া ওরই বা কী দায়, বোঝানোর? ওর কী একটা আত্মসম্মান নেই? যে কোনো মেয়েই চায় তার পছন্দের পুরুষটা তার সামনে এসে আত্মসমর্পণ কোরুক, নীলাও চায়। অন্যায় তো নেই তাতে। তবু এত কিছুর পরেও সেই একটা খচ্‌খচানি রয়েই গ্যালো। ভীষণ ইচ্ছা করছিলো একবার.....অন্তত একবার ছুট্টে গিয়ে ঐ মুখটা নিজের বুকে চেপে ধরতে, অস্ফুটে নীলা বলে ওঠে, "ক্যানো কাঁদাও?”
রেডিওতে আর-জে তখন বাজাচ্ছে,
"না জানে কিঁউ
দিল ইঁয়ু সাতায়েঁ
বিতে হ্যায় রাত
পার নিঁদ না আয়ে”............
#রাজা
--উফ্‌ মা!! আর কত দেরী করবে? খেতে দাও....পড়াতে যাব তো!!
--রান্না না হলে কী দিয়ে খেতে দেবো? খেতে বসে তো তোমাদের বাপ-ব্যাটার আবার চব্য-চোষ্য চাই! আর ১০ মিনিট লাগবে। আলু চচ্চড়িটা হলেই দিয়ে দেবো।
--কী এমন কোপ্তা-কালিয়া রাঁধ যে এত দেরী হয়? বলছি পড়ানো আছে ৪টে থেকে। আগের সপ্তাহে দেরী হয়েছে, এরপর তো ছাড়িয়ে দেবে!!!
--কী এমন রাঁধি মানে?? ঐ....ঐ জানোয়ার!! সারাদিন-সারা হপ্তা ধরে গুষ্টির পিন্ডি কে রাঁধে? জুতাবো ধরে!! বাপে দু-পয়সা ঘরে আনতে পারেনা ছেলের যত বড় মুখ নয় তত বড় কথা। দামড়া ছেলে কোথায় দুটো ট্যাকা ঘরে আনবে তা না, সারাদিন বড়লোক বন্ধুদের সাথে টইটই আর সাকুল্যে দুটো টিউশানি। বলি খুব তো বন্ধুদের সাথে মেশো, তা তাদের বলে একটা কাজ জোটাতে পারছ না?
--আবার তুমি শুরু করলে? প্লিজ থামো না এবার!! না হলে বল আমি পড়াতে যাই, দরকার নেই খাওয়ার।
দুপ্‌দাপ করে ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে আসে রাজা। উঠোনে দাঁড় করানো সাইকেলটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ে, বেড়াটা আটকাতেও ভুলে যায়! মা তখনো চিৎকার করছে, "খাস না শূয়ার! কে খেতে বলেছে? ঐ বন্ধুদেরই বলিস গেলাতে তোকে”।

সাইকেলটা নিয়ে হাঁটতে শুরু করলো ও। ভেবেছিলো আজ রোববার, অন্তত বাবার সাথে একসাথে খেয়ে পড়াতে যাবে। সব কপাল...মাঝে মাঝে মরে যেতে ইচ্ছে হয় রাজার। ছোটবেলা থেকেই এই এক কামরার ঘর আর চিলতে বারান্দায় ওর শৈশব কৈশোর কোথা দিয়ে যে কেটে গ্যালো ও নিজেও টের পায়না। নিজের অস্তিত্বের মূল্যহীনতা মানুষ তখন টের পায় যখন তার স্বপ্ন গুলো আঙ্গুলের ফাঁক গলে ঝরে পড়ে। সারাটা জীবন কী এভাবেই “কনসেশান”-এ ভর করেই কাটবে ওর? স্টুডেন্ট ঠেঙ্গিয়ে আর বাবার সাথে ঠোঙ্গা বানিয়ে আর যাই হোক জীবনে বড় কিছু করা যায়না। জীবনটা রিল-লাইফ নয় যে হঠাৎ কোনো এক মন্ত্রবলে মিথ্যে গুলো সত্যি হয়ে যাবে। তাও যদি একটা পয়সাওয়ালা নায়িকা ওর প্রেমে পরতো, কথাটা ভেবেই ও ফিক্‌ করে হেসে ফ্যালে। দু’বেলা খাবারের ঠিক নেই সে ভাবছে প্রেম-পিরিতের কথা! মাঝে মাঝে নিজের ওপর ভীষণ রাগ হয় রাজার, ক্যানো এভাবে নিজের ধ্বংস হয়ে যাওয়াটা ওকে দেখতে হবে? ইচ্ছে করে বাবাকে গিয়ে প্রশ্ন করতে, “আমাকে তো খুব পড়াশুনার কথা বলতে, নিজে স্টুডেন্ট লাইফে পড়নি ক্যানো ঠিকঠাক”? আজ যদি রাজার বাবাও কারখানার লেবার না হয়ে একটা বড় অফিসে চাকরি করতো তালে হয়তো ওর আর্টস কলেজে পড়ার স্বপ্ন সত্যি হতো, একদিন ওরও ছবির প্রদর্শনী হতো বড় বড় গ্যালারিতে। ক্রিটিকস্‌দের চর্চায় রাজীব সেন নামটা বারবার উঠে আসতো। অনিমেষদা বারবার বলতো “তোর হবে, ভগবান তোকে কী ক্ষমতা দিয়েছেন তুই নিজেও জানিস না”। আর ক্ষমতা...এখন নিজের রং-তুলি গুলোর দিকে তাকালে রাজার চিৎকার করতে ইচ্ছে করে। ক্যানভাসে ডুবে থাকা ছেলেটা এখন চেনা পরিচিতের দৌলতে কিছু বিয়ের কার্ড আর পুজোর মরশুমে আশপাশের কয়েকটা পুজোর স্যুভেনির ইলাসট্রেশানের কাজ করে বেড়ায়। পাড়ার পুজোয় বন্ধুদের মাঝে জৌলুসহীন হয়ে বসে থাকা আর নামী পুজোর উদ্বোধন করা, দুটো জগৎ যে সম্পূর্ণ আলাদা এটা রাজা বোঝে। প্রথমটা টিকে থাকা আর পরেরটা এনজয় দ্য লাইফ। আসলে বাবার পঙ্গু হয়ে যাওয়াটা মা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেনি। সেদিনটা রাজা এখনো ভুলতে পারেনা। ১২ই নভেম্বার.....রাত দশটা বাজতে যায়, বাবাকে ফিরতে না দেখে মা-ই ওকে বলেছিলো একটু সাইকেলটা নিয়ে এগিয়ে দেখতে। বেরোতে যাবে এমন সময় ক্লাবের কিছু ছেলে আর বাবার কারখানার আরও দু’জন এসে খবরটা দেয়। সারমর্ম তাড়াহুড়োয় লাইন ক্রস করতে গিয়ে বাবার ডান পা টা হাঁটু থেকে নেই। মায়ের কান্নাকাটি, পাড়া-পড়শীর সান্ত্বনা, আত্মীয়-স্বজনের সামান্য আর্থিক সাহায্য, বন্ধুদের হসপিটালে রাত জাগা সবই হয়েছে নিয়ম মেনে শুধু সেই রাতের পর থেকে রাজা ট্র্যাক ছেড়ে বেরিয়ে গ্যাছে। নেহাৎ ক্লাস ১২ বলে স্কুল কমিটি উচ্চ-মাধ্যমিকটা দিতে দিয়েছিলো,কিন্তু পরবর্তী ধাপ গুলো রাজার আর দ্যাখা হয়নি। কৌশিক, অভি, অনি-রা যেদিন প্রথম কলেজে ক্লাস করতে গ্যালো সেদিন রাতে রাজা কেঁদে ফেলেছিলো বারান্দায় বসে, আর তখনই বুঝে গ্যাছিলো একটা মানুষের পা না থাকাটা আরও অনেকগুলো মানুষকে পঙ্গু করে দেয়, বিশেষ করে মানুষটার পরিচয় যদি বাবা হয়।

#অভিষেক

-হ্যালো
-হ্যাঁ বলো
-এই! তুই যে আমায় বিকেলে ডাকলি বললি না তো কোথায় মীট করবি? আর কখনই বা দেখা করবি?
-ওহ্‌! তখন ভুলে গ্যাছি বলতে। সরিইইই.... শোনো না! এই ধরো সাড়ে ছ’টা, আমার নাচের স্কুলের ওখানটায় আসতে পারবে?
-সাড়ে ছ’টা মানে বিকেল আজ জানলাম....যাক গে! নাচের স্কুলের সামনে দাঁড়ালে তোর প্রবলেম নেই তো?
-প্রবলেম কীসের?
-না, এর আগেও একদিন ডেকেছিলি তখন বলছিলি না, বন্ধুরা কী ভাববে, তাই বললাম!
-হ্যাঁ তুমি একদম সামনেটায় এসো না, স্কুলের একটু আগে দেখবে একটা গিফটের দোকান আছে, ওখানটায় থেকো।
_ওয়ে! এটা আমার এলাকা, আমায় চেনাস না....আমার ঠাকুমা এসছেন!
-হুঁহ্‌! ভালো যাও! আমি রাখলাম। দেরী কোরো না। বাই....
-বাইইই...

আহাহাহা....আজ মনে হয় দিনটা শুভ যাবে, কী বলেন আপনারা? না মানে ভেবে দেখুন, নীলা যেরকম চাপা মেয়ে তাতে ও নিজে থেকে আজ আবার আমায় ডাকলো, লাড্ডু তো ফুটবেই বলুন? যদি সব ঠিকঠাক যায় তালে আজকেই ওকে প্রপোজটা করে ফেলবো, অ্যাটলিস্ট ও কী ভাবছে আমাকে নিয়ে সেটা আজ আমায় বার করতেই হবে। ওফ্‌....তারপর পায় কে আমায়। পুরো শাহ্‌রুখের মত দু’হাত ছড়িয়ে ললনাকে বক্ষে টেনে নেবো। ব্যাস জমে ক্ষীর!! টুকটাক এদিক-সেদিক ঘোরাঘুরি, পূজোয় ঠাকুর দ্যাখা, সিনেমা এই করে বছর তিনেক কাটিয়ে দিলেই মার দিয়া কেল্লা। তারমধ্যেই একটা চাকরিও আশা করি জুটে যাবে যা রেজাল্ট আছে তাতে। ব্যাস, সুন্দরী বৌ-বাপ-মা নিয়ে ভরা সংসার, আর কী চাই লাইফে। এই রে...........আমি তো দেখছি পুরো গ্যাস বেলুন হয়ে গ্যালাম। না না শিগগির নীচে নামি, শেষে এসবের কিস্যুটি না হলে বড্ড লাগবে!! দেখেছেন আবার চলে এলাম নিজের কথা বলতে। আরে এখনো তো অনি আর কৌশিকের সাথে আলাপই করালাম না আপনাদের। চলুন চলুন আগে ওদের সাথে আলাপটা করিয়ে দি, আর শুনুন না...বলছি আপনাদের ঐ ভগাদা’র কাছে একটু আমার নামে একটা পুজো দিয়ে দেবেন ক্যামোন, মানে নীলা যাতে.....হেঁ হেঁ! বোঝেনই তো...

#অনির্বাণ
চিলেকোঠার এই ঘরটা অনির খুব প্রিয়। সারা সপ্তাহের খাটাখাটনির শেষে রোববারের সারাদিন এই ঘরটা ওর কাছে এক ঝলক টাটকা বাতাস। ঠাকুমার কাছে শুনেছে এই ঘরটা নাকি ওর ঠাকুরদা বানিয়েছিলেন নিজের জন্য। কোর্ট থেকে ফিরে চলে আসতেন এই ঘরটায়। তারপর এখানে বসেই সেরে ফেলতেন টুকিটাকি মামলা সংক্রান্ত কাজ। কোনোদিন আবার ঠাকুমাকে ডেকে নিতেন, তারপর দুজনে মিলে চলত গ্রামোফোনে গান শোনা। ঠাকুরদার সেই গ্রামোফোন আর কিছু পুরোনো রেকর্ড এখনও রাখা আছে এ ঘরের দেওয়াল আলমারিতে। অনির রোববারটা কেটে যায় এগুলো নিয়েই। সাথে থাকে নিজের গীটারটা আর ঠাকুরদার রেখে যাওয়া অঢেল বইয়ের কালেকশান। ওর নিজেরও আছে কিছু। এখন প্রায় ৯টা বাজতে যায়। অনি চুপচাপ শুয়ে আছে বিছানায়। কড়িবরগা দেওয়া সিলিংয়ের দিকে চেয়ে চুপচাপ পড়ে আছে ও। এতক্ষণ গীটারটা নিয়ে টুং টাং করছিলো। একটা নতুন সুর তোলার চেষ্টা করছিলো, মন বসলো না। তারপর একটা বই নিয়ে পড়ার চেষ্টা করলো। কিছুতেই কিছু হলো না। সন্ধ্যেবেলার দৃশ্যটা কিছুতেই ওর মাথা থেকে যাচ্ছে না। রোজকার মত আজও অনি বেরিয়েছিলো ৬টার একটু পরে। রোজ কলেজ থেকে বাড়ী ফেরার সময় ও হেঁটেই ফেরে স্টেশানে এসে। ফেরার পথে একটা সিগারেট খাওয়া ওর অভ্যাস। অনি কোনওভাবেই স্মোকার নয়। সারাদিনে ঐ একটাই ওর চাই। আসলে ও নিজের ঠোঁট নিয়ে ভীষণ সচেতন। কোন ছোটবেলায় ওর বদ্ধমূল ধারণা হয়েছিলো সিগ্রেট খেলে ঠোঁট কালো হয়ে যাবে আর লোকে ওকে বাজে ছেলে বলবে! এখন মনে পড়লে আপনমনে হেসে ফ্যালে, কিন্তু সিগ্রেটটা ওর আর ঠিকঠাক খাওয়া হয়ে উঠলো না। দিনে একবার ঐ সন্ধ্যে নাগাদ, ব্যাস। প্রথম খেয়েছিলো ক্লাস ১২-এ। উচ্চ মাধ্যমিকের পর। অভি খাইয়েছিলো। এসব ভুলভাল কাজে অভিই ছিলো ওদের গুরুঠাকুর। প্রথম সিগ্রেট থেকে শুরু করে প্রথম হলদে মলাটের বই, সবেরই হাতেখড়ি অভির দয়ায়। অন্য দিন হলে অভির নামটা মনে পড়লেই অনির্বাণের হাসি পেয়ে যায়। ওরম জমাটি ছেলে খুব কমই আসে। অভির মধ্যে একটা, মন-ভালো-করা, ব্যাপার আছে। কাউকে একটু গোমড়া মুখে দেখলেই হয়েছে.....খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তার পেট থেকে কথা বার করে তাকে না হাসিয়ে ছাড়বে না। কিন্তু আজ কিছুতেই মন থেকে খচ্‌খচানিটা যাচ্ছে না। সন্ধ্যেবেলা সিগারেটটা নিয়ে আপন মনে হাঁটতে হাঁটতে কখন য্যানো নীলার নাচের স্কুলের সামনেটায় চলে এসেছিলো। ইচ্ছে করে যে এসেছে ঠিক তা নয়, আবার একেবারে অস্বীকারও করতে পারে না যে আসার ইচ্ছে হয়নি। আসলে অনি যতই নিজেকে নিজে ধমক দিক, এটা ওর কাছে এখন দিনের আলোর মত পরিষ্কার যে ও নীলাকে ভালোবাসে। হ্যাঁ, নীলাকে ও খুব ভালোবাসে, কিন্তু মুখ ফুটে বলতে পারে না। আর নীলার মত চুপচাপ মেয়ের মনের কথা জানার জন্য যতটা সাহস দরকার তা ওর মধ্যে নেই। তবে আজকের দৃশ্যটা দ্যাখার পর অনি ভেতরে ভেতরে একটু টলে গ্যাছে। নীলা আর অভি.......দু’জন পাশাপাশি হাঁটছে। অভি কিছু একটা বলছে আর নীলা খিলখিল করে হাসছে। ওরা নিজেদের মধ্যে এতটাই মশগুল যে একটু দূরেই দাঁড়ানো অনিকে খেয়াল পর্যন্ত করেনি কেউ। দুধ সাদা চুড়িদারে নীলাকে ঠিক মরালীর মত লাগছিলো।

-- বাবু! নীচে আয়, অভি ডাকছে তোকে।

বাবার ডাকে সম্বিত ফেরে ওর....উঠে বসে তাড়াতাড়ি। ঘড়ির দিকে তাকায়, পৌনে দশটা বাজে, অভি এই সময়ে, কি ব্যাপার?

-- একটু দাঁড়াতে বলো, একেবারে ছাদের দরজায় তালা দিয়ে আসছি।

#কৌশিক

অ্যাসাইনমেন্টের কাজ শেষ। আজ আর এনার্জি নেই একদম। আপাততঃ দুটো সপ্তাহ একটু হাল্কা যাবে এবার কলেজে। এর মধ্যেই খানিকটা পড়াশুনা করে রাখতে হবে, সেমেস্টার আসতে বেশী দেরী নেই আর। একবার ভালোয় ভালোয় উতরোতে পারলে ক্যাম্পাসিংয়ে দামী কোম্পানিতে দামী মাইনের চাকরি বাঁধা। তখন সবাই দেখবে কৌশিক লাহিড়ী কি চিজ্‌। বিশেষ করে অনি....বরাবরের প্রতিদ্বন্দ্বী ওর। স্কুলে একবার কৌশিক তো একবার অনি, ফার্স্ট প্রাইজ এই দুজনের মধ্যেই ঘুরপাক খেতো। অনিকে এইটাই শেষ সুযোগ দেখিয়ে দেওয়ার যে কৌশিক ওর থেকে বেশী ভালো পড়াশুনায়। হতে পারে অনি ভালো গীটার বাজায়, গানের গলাও ভালো, কলেজে মেয়েরা একটু বেশীই হামলে পড়ে ওকে নিয়ে, কিন্তু এসব দিয়ে কেরিয়ারের দৌড়ে কৌশিককে হারানো যাবেনা। ওর জীবনের মন্ত্র একটাই, টাকা থাকলে দুনিয়ায় সব মেলে। আর মানিব্যাগ যত মোটা হবে সুন্দরীদের ভীড়ও ততই বাড়বে। ওসব ফালতু গান-বাজনায় টাইম ওয়েস্ট করে, মেয়েদের ইম্প্রেস করে নিজের কেরিয়ারটা ক্যাঁচাতে চায়না ও। যদিও তিয়াসাকে ওর খারাপ লাগেনা। তবে মেয়েটাকে এখনও কিছু বলেনি, আসলে এসব নিয়ে ভেবে টাইম লস্‌ করলে লাইফ হেল। তার চেয়ে বেটার ভালো চাকরি পেয়ে তখন তিয়াসাকে নিয়ে ভাবা যাবে। ততদিন খালি থাকলে ভালো নাহলে হাজারটা এরম তিয়াসা আছে, যে কোনও একটাকে তুলে নেবে। এই মূহুর্তে টার্গেট লাস্ট সেমেস্টার। আর ক’টা মাস....তারপরেই প্রমাণ হয়ে যাবে কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংটা কার কাপ্‌ অব্‌ টি। তখন এই অভি, অনি, রাজাদের কাছে ওর কদরই আলাদা। বিশেষ করে ঐ রাজাটা। একদম সহ্য হয়না কৌশিকের, নেহাৎ ছোট বেলার বন্ধু তাই কিছু বলেনা। আরে বাবা, অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে তোর বাবার তা বলে তুই ওরম বিশ্ব ভ্যাগাবন্ড হয়ে ঘুরে ব্যাড়াবি!! কি না বাবু টিউশানি করেন আর ছবি আঁকেন। আরে সালা ওরম হাজারটা আর্টিস্ট ছড়িয়ে আছে চারদিকে। কোথায় পড়াশুনা করবি তা না ছোট থেকে কোন এক ইয়ের কাছে গিয়ে আঁকা শিখত, সেই নিয়েই পড়ে থাকে সারাদিন। বাপের টাকার জোর নেই তো কি হয়েছে, তুই মন দিয়ে পড়ে রেজাল্ট ভালো করে একটা স্কলারশিপ জোটাতে পারলি না ক্যানো? মোদ্দা কথা হলো উন্নতির ইচ্ছে নেই এসব ছেলেদের। বোগাস....সমাজে বোঝা বাড়াতে এসেছে। দু’দিন পর ফ্যা ফ্যা করে ঘুরবে এদিক সেদিক, আর বন্ধুদের কাছে এসে বিড়ি খাওয়ার জন্য হাত পাতবে। গান্ডু স্লা..... দেবে! সেদিন বিড়ি ক্যানো আস্ত সিগ্রেটের প্যাকেট কিনে হাতে ধরিয়ে দেবে! একটা বিজাতীয় উল্লাস গ্রাস করতে থাকে কৌশিককে। চোখের সামনে ভেসে ওঠে ঝাঁ চক্‌চকে ফ্লোর, একটা ওয়েল ডিজাইনড কিউবিকল, দামী গাড়ী......আস্তে আস্তে বালিশে মাথা রাখে ও!!

#নীলা

নাহ্‌! এবারেও বলা হলো না কথাটা অভিদাকে। এই নিয়ে দু’দিন ডেকে পাঠালো, একথা সেকথায় কোথা দিয়ে যে সময়টা কেটে গ্যালো, কিছু বোঝার আগেই সময় শেষ। ধুস্‌...আর কবে বলবে ও। এদিকে কিচ্ছু ভাল্লাগেনা। ক্লাস বাঙ্ক করে ক্যান্টিনে এসেছে বন্ধুদের সাথে। সবাই আড্ডা দিচ্ছে, শুধু নীলার মনটাই পড়ে আছে দূরে.....খুব দূরে, কোনও একটা নাম না জানা পাহাড়ি রাস্তার বাঁকে। বাঁকের ওপারে কি আছে জানেনা, শুধু জানে বাঁকটা পেরোতে হবে, পেরোতেই হবে যেভাবে হোক। নীলার পা ভারী হয়ে আসছে, শ্বাস-প্রশ্বাস দ্রুত হচ্ছে ক্রমশঃ, তবু সেই মনের জোরটুকু পাচ্ছে না। যেটুকু সম্বল করে মানুষ বেঁচে ন্যায় প্রতিটা দিন, হাত ধরে নিজের ভালোবাসার, খুঁজে ন্যায় ভীষণ ভাবে নিজস্ব একটা পৃথিবী। ওপারে কি কেউ আছে আদৌ? সেও কি একইভাবে ভয় পাচ্ছে বাঁকটা পেরোতে? তারও কি ইচ্ছে হয় এভাবে ছুটে এসে নীলাকে জড়িয়ে ধরতে? সেই মানুষটাও কি চায় ওরই মত করে ভালোবেসে মনখারাপের দোসর হতে? কিচ্ছু বুঝতে পারছে না....সব ক্যামোন ধূসর হয়ে আসছে। নিজেকে আজকাল ক্যামোন যন্ত্রের মত মনে হয় ওর। সবই করছে....শুধু অভ্যেস তাই, মনটা গেঁথে আছে ঐ দুটো মায়াবী চোখে। অজান্তেই চোখ দুটো ভারী হয়ে আসে।

--এই তোরা আড্ডা মার, আমি চললাম, মাথাটা ধরেছে। কাল নাও আসতে পারি।

কোনওমতে কথাগুলো ছুঁড়ে দিয়ে কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই, নীলা হন্‌হন্‌ করে হাঁটা লাগায় গেটের দিকে।

#অনির্বাণ

সাড়ে ৬টা বাজতে যায়! রাজাটা এখনও এলো না। অথচ সেদিন এমনভাবে বললো য্যানো খুব জরুরী কিছু বলবে। ধুস্‌! এমনিই মন মেজাজ ভালো নেই তায় উটকো ঝামেলা যত। কি ভ্যাজাবে এখন এসে কে জানে। আজকাল কলেজ থেকে ফিরতে একটু দেরী হয় বলে আর চায়ের দোকানে যায়না, তাছাড়া সামনে সেমেস্টারটাও আসছে। অভি-কৌশিক ওরাও এখন আসা কমিয়ে দিয়েছে। সেদিনও একটু রাত করেই ফিরছে, হঠাৎ পেছন থেকে রাজার আওয়াজ,

-- অ্যাই অনি!
--
-- দেখতেই পাচ্ছিস না আজকাল হ্যাঁ??
-- আরে নারে! দেখছিসই তো সবে বাড়ী ফিরছি! টায়ার্ড!
-- ৫ মিনিট হবে? কথা ছিলো!
--
-- চল! ঠেকে চল
অগত্যা! খানিকটা বাধ্য হয়েই আসতে হলো রাজার সাথে।

-- কি হয়েছে বলতো তোর? এরম ন্যাতানো পাঁপড় হয়ে আছিস ক্যানো?
-- কি হবে? কিছুই না!!
-- বললেই হলো? সালা....অভিটাকেও দেখছি দু’দিন ধরে! ঠেকে আসছে না। কি কেস্‌ বলতো?
-- আচ্ছা মুশকিল! আমি কি করে বলবো? ওর সাথে আমার সেই লাস্ট রোববার দ্যাখা হয়েছে, মাঝে চারটে দিন কেটে গ্যাছে। দ্যাখ হয়ত চাকরির পড়াশুনা নিয়ে ব্যস্ত।
-- আর তুমি?? তুমি কি নিয়ে ব্যস্ত?
-- সেমেস্টার নিয়ে......হয়েছে!! জ্বালিয়ে মারলি! এই তোর কথা?
-- রাগ্‌ করছিস ক্যানো? একটা চা খাওয়া না!
-- গোপালদা! একটা দুধ একটা লিকার!
-- ভাই! তোকে আমার কিছু বলার আছে! একটু সময় হবে?
-- হুম! বল?
-- না মানে এখন নয়! এই ধর রোববার যদি পড়িয়ে তোর বাড়ী যাই?
-- ঠিকাছে!! কখন তাও?
-- এই ধর সাড়ে ৬টা!
-- হুম!

নাহ্‌...ফালতু ভেবে লাভ নেই। আসার হলে আসবে। বইখাতা নিয়ে বসা যাক। অভির দেওয়া কাজটাও করে রাখতে হবে। যত কষ্টই হোক, বন্ধুকে যখন কথা দিয়েছে তখন ফেরাবে না। লিখবে....খুব সুন্দর করে একটা কবিতা লিখে দেবে, যাতে নীলা ওকে ফেরাতে না পারে।

-- কি গুরু? এরম ভূতের মত অন্ধকারে একা বসে?
-- ওহ্‌ এসেছিস!!
-- আলোটা জ্বালি?
--জ্বাল!
-- অনি!
-- উঁ!
-- কি হয়েছে তোর? মনখারাপ?
-- না তো!!
-- বললেই হলো! স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি তোর চোখে জল!
-- হুট সালা...খালি ভাঁটের কথা যত!
-- ভাই!! নাহয় পেটের দায়ে ভুলভাল কাজ করতে হয়, তাই বলে শিল্পীর চোখকে ফাঁকি দিবি!!
-- ফাঁকি দেওয়ার কথা উঠছে ক্যানো! বললাম তো কিছু হয়নি! কি বলবি বলে এসেছিস, বললি না তো!
-- আমায় বন্ধু ভাবিসনা তাই না রে?
-- ধ্যাৎ! কোনওদিন বলেছি তাই...
-- বলিসনি! কিন্তু বুঝি! আর ঠিকই তো!! কোথায় তোরা আর কোথায় আমি!! তোদের ছায়ার পাশে দাঁড়ানোর অউকাত টুকুও নেই আমার...
-- রাজা! বন্ধুত্বে যোগ্যতা লাগে না...বন্ধু বন্ধুই থাকে! য্যামনই হোক না ক্যানো!
-- তাহলে বল কাঁদছিলি ক্যানো?
-- আরে কাঁদিনি! অন্ধকারে বসে ছিলাম, হুট করে আলো জ্বাললি তাই চোখটা ধাঁধিয়ে গ্যাছিলো!
-- এসব বস্তা পচা ডায়লগ অন্য কাউকে দিস! আমায় না.....বলবি নাকি থাবড়া মারবো? যতই আধপেটা খাই আমার থাবড়ায় জোর কমেনি কিন্তু। মনে আছে ছোটবেলায় মারপিট হলে কে সবার সামনে থাকত?
-- কি শুনতে চাস?
-- যা হয়েছে! যেটা ভেবে কষ্ট পাচ্ছিস!!
-- নীলা.....
-- মানে?
-- আমি নীলাকে ভালোবাসি.......
--
-- কিছু বললি না তো?
-- বলেছিস ওকে?
-- না..
-- ক্যানো?
-- আমি জানিনা ওরও আমাকে ভালোলাগে কিনা! আর তাছাড়া অভি....
-- অভি কি? অভিও ওকে ভালোবাসে?
-- হুম
-- কে বললো?
-- অভি নিজেই বলেছে! গত রোববার এসেছিলো! ও নীলাকে প্রপোজ করতে চায়, আমায় বলেছে একটা কবিতা লিখে দিতে! নীলা আর অভি দ্যাখাও করেছে দু’বার। অভি ওকে বলতে পারেনি, কিন্তু আর দেরী করতে চায়না। সামনের উইকেই বলে দেবে ঠিক করেছে। আমায় ধরেছে ওর প্রেমপত্র লিখে দেওয়ার জন্য।
-- তুই কি বললি?
-- হ্যাঁ বলেছি....
-- তুই কি পাগল?? ওকে বললি না ক্যানো যে তুইও নীলাকে ভালোবাসিস?
-- তুই ক্ষেপেছিস? অভিকে চিনিস না? দেখবি সালা নিজেই উপযাচক হয়ে নীলার সাথে একেবারে আমার সম্বন্ধ করে আসবে। না রে....অভিটা বড্ড ভালো ছেলে! ও নীলাকে ভালো রাখতে পারবে। আর তাছাড়া আমি তো নীলাকে কিছু জানাইনি। নাহ্‌! আমি ঠিক করে নিয়েছি, কাউকে কিচ্ছু বলবো না। নীলা-অভি-কৌশিক কেউ কিচ্ছু জানবে না। অভির সাথে যখন থাকে তখন নীলাকে আমি হাসতে দেখেছি। ওরম হাসি শেষ কবে হেসেছে মনে করতে পারিনা। ওদের মানাবে ভালো, দেখিস! সব্বাই ভালো থাকবো আমরা এভাবেই। আজ আমি ওদের মাঝে চলে এলে সম্পর্কগুলো মূল্যহীন হয়ে যাবে। অভি আমার কথা ভেবে স্যাক্রিফাইস করবে, নীলা দোটানার মধ্যে পড়ে যাবে। হয়ত খারাপ কিছু হয়ে যেতে পারে। না ভাই...পারবো না! বড্ড ছোট হয়ে যাব নিজের কাছে নিজে। অভির আর আমার বন্ধুত্ব তো আজকের নয়, সেই কবেকার। বন্ধুর জন্য লোকে কত কি করে ফেলছে দুনিয়ায় আর আমি সামান্য একটা মেয়েকে ভুলে যেতে পারবো না!! ঠিক পারবো....পারতে আমাকে হবেই।

একটা রিকোয়েস্ট করবো?

--
-- যা শুনলি ভুলে যা! সব ভুলে যা! কিচ্ছুটি বলিস না কাউকে। যা হচ্ছে হতে দে! আর তো ক’টা মাস! তারপর হয়ত চাকরি নিয়ে এখান থেকে চলে যাব। এত বড় পৃথিবীটায় বেঁচে থাকার মত অনেক কিছু খুঁজে নিতে পারবো। কিন্তু তোদের হারিয়ে ফেললে একবার বেঁচে থাকাটা রুটিন হয়ে যাবে জাস্ট। তার চেয়ে মাঝেমাঝেই আসবো। সবাই মিলে রিইউনিয়ন হবে, জমিয়ে হুল্লোড় করবো, আমি গান শোনাবো গীটার বাজাবো, অভি মজার মজার জোকস্‌ বলবে, তুই ছবি আঁকবি.......ভালো থাকবো। অ্যাটলিস্ট আমরা সবাই খোলামনে হাসতে পারবো! বলিস না কাউকে কিছু....
-- হুম্‌! চলি আজ..
-- সেকি! কি বলবি বলে এলি যে!
-- কিছু নাহ্‌! সামান্য সমস্যা....ম্যানেজ করে নেবো! আসছি......
-- আলোটা নিভিয়ে যাস্‌!

অনি আবার সঁপে দ্যায় নিজেকে অন্ধকারে। সামনে রাখা গীটারের তার গুলো হাল্কা আলোয় চিক্‌চিক করছে। চোখটা আবার ধাঁধিয়ে ওঠে....আলো থেকে অন্ধকারে এলেও ধাঁধা লাগে বইকি।

#রাজা
চেনা চেহারাটা ক্রমশঃ এগিয়ে যেতে থাকে। আর কয়েক পা....তারপরেই সব সমস্যার সমাধান। কাল রাতে অনির বাড়ী থেকে ফেরার পথেই ঠিক করে ন্যায়, এর একটা হেস্তনেস্ত না করে ছাড়বে না। কিছু একটা করতেই হবে। কোনও একজনকে জায়গা ছেড়ে দিতে হবে। কিন্তু সেটা কে, তা এবার রাজা ঠিক করবে। দেখিয়ে দেবে বন্ধুদের ওরও অনেক কিছু করার ক্ষমতা আছে। প্রায় এসে গ্যাছে কাছে। পায়ের আওয়াজে ছায়ামূর্তি এবার ঘুরে দাঁড়ায় ওর দিকে। রাজা আর ও এবার মুখোমুখি। বড় করে একটা শ্বাস নিয়ে ন্যায়.....


#অভিষেক

কি বস্‌? হলো আলাপ বাকীদের সাথে? কি ভাবছিলে? ছেলেটা এতদিন ধরে স্নান-খাওয়া করছিলো? আরে না রে বাবা.....মজা দেখছিলাম। আড়াল থেকে দাঁড়িয়ে তোমাদের আলাপচারিতা রসিয়ে রসিয়ে শুনছিলাম। ওফ্‌! জানিরে বাবা তর সইছে না তোমাদের। রাজা আর নীলা কি কথা বললো, নীলার সাথে কার প্রেম হলো, এসব না বললে আমার নিস্তার নেই জানি। তার আগে দাঁড়াও....তোমরা এই মূহুর্তে কোথায় আছ সেটা তো জেনে নাও। এখন আমরা ৬টা বছর এগিয়ে এসেছি। ওমা! চোখ বড় বড় করার কি হলো? আরে বাবা এতক্ষণ ফ্ল্যাশব্যাকে ছিলে এবার ফেরৎ এসেছো। ল্যাঠা চুকে গ্যালো। বলি সময় নিয়ে মাথা ঘামাবে নাকি বাকীটা শুনবে? রাজা নীলাকে কি বলেছে তাইতো? শোনো....

-- নীলা! তোর সাথে আমার কয়েকটা কথা আছে.....
-- বলো? তাড়াতাড়ি বলবে, বাড়ী ফিরতে হবে....
-- তোর জন্য একটা কবিতা লিখেছি! শুনবি?
-- হোয়্যাট?
-- মানে.....তোকে আমার ভালোলাগে। আমি ভালোবাসি তোকে!
-- আর য়্যু আউট অফ্‌ ইওর মাইন্ড? কি যোগ্যতা আছে তোমার আমাকে ভালোবাসার? লজ্জা করে না আবার আমার সামনে দাঁড়িয়ে বলছ?
-- এসব কি বলছিস তুই?
-- যা বলছি ঠিকই বলছি। নেহাত দা’ভাইয়ের বন্ধু, তাই তোমার সাথে ভালোভাবে কথা বলি। তার মানে এই নয় যে তুমি তার সুযোগ নেবে। সামান্য ছবি এঁকে নিজেরটাও চালাতে পারোনা, আমাকে ভালোবাসার কথা বলছ? শোনো! এমনিই আমার মাথার ঠিক নেই...রাগিয়ো না!
-- প্লিজ্‌! একটু শোন....
-- আর কিচ্ছু শোনার নেই!! স্পষ্ট ভাষায় বলছি, আমি তোমাকে ভালোবাসি না! তোমাকে দাদার বন্ধু হিসেবেই দেখি, তার বেশী না। আর আরও শুনে রাখো, আমি অনি’দাকে ভালোবাসি।
-- অনির্বাণ?
-- হুম!
-- আমি গরীব বলে আমায় রিজেক্ট করলি? বিশ্বাস কর....আমি তোকে প্রথম দিন থেকে ভালোবাসি।
-- শাট্‌ আপ! আমিও প্রথমদিন থেকেই অনি’দাকে ভালোবাসি। কতটা ভালোবাসি তোমার কোনও ধারণা নেই। ঐ ছেলেটা ছাড়া আর কাউকে ভাবতে পারিনা। ইনফ্যাক্ট অভি’দাকে দিয়ে বলাবার চেষ্টা করেছি....সাহস করে বলে উঠতে পারিনি। পারো ওরম গীটার বাজাতে? ওরম ভাবে খোলা গলায় গান গাইতে পারো? পারো না! কেউ পারবে না....অনি’দার মত কেউ পারে না!
--
-- আশা করি আর কিছু বলার নেই তোমার। উত্তর পেয়ে গ্যাছো! আমি চললাম!
--
রাজা হতভম্বের মত দাঁড়িয়ে থাকে। এভাবে অপমান করলো ওকে! কি পেয়েছে কি এরা? ও গরীব বলে কি ওর কাউকে ভালোবাসার অধিকার নেই? এভাবে সব ছেড়ে দেবে ও? ক্যানো? ওর অন্যায়টা কোথায়? না.... চেনা চেহারাটা ক্রমশঃ এগিয়ে যেতে থাকে। আর কয়েক পা....তারপরেই সব সমস্যার সমাধান। কাল রাতে অনির বাড়ী থেকে ফেরার পথেই ঠিক করে ন্যায়, এর একটা হেস্তনেস্ত না করে ছাড়বে না। কিছু একটা করতেই হবে। কোনও একজনকে জায়গা ছেড়ে দিতে হবে। কিন্তু সেটা কে, তা এবার রাজা ঠিক করবে। দেখিয়ে দেবে বন্ধুদের ওরও অনেক কিছু করার ক্ষমতা আছে। প্রায় এসে গ্যাছে কাছে। পায়ের আওয়াজে ছায়ামূর্তি এবার ঘুরে দাঁড়ায় ওর দিকে। রাজা আর ও এবার মুখোমুখি। বড় করে একটা শ্বাস নিয়ে ন্যায়.....

-- আঁক!
শেষ! একবার মারতেই পড়ে গ্যাছে মেয়েটা! ধীরে সুস্থে ওর বুকের ওপর চেপে বসে হাতে ধরা কংক্রিটের চাঙড়টা দিয়ে আরও কয়েকবার আঘাত করে নীলার মাথায়। রক্ত ছিটকে এসেছে সারা মুখে। মাথার ভেতর থেকে ঘিলু বেরিয়ে এসেছে। আহ্‌....শান্তি। নীলা যখন আমার হলো না! তখন কাউকে হতে দেবো না। কেউ পাবে না ওকে.... চিৎকার করে ওঠে রাজা পাগলের মত, “দেখে যা অনি! রাজা জিতে গ্যাছে আজ। তুই অভি কেউ পেলি না ওকে! কেউ না! ওর চলে যাওয়াটুকুও দেখতে পেলিনা.....আমি দেখতে দিলাম না তোদের! হাহাহাহা.....জিতে গ্যাছি আজ! একবার তোদের টেক্কা দিতে পারলাম!”

বোঝা গ্যালো কি ঘটেছিলো? কি ভাবছ? রাজা কোথায় এখন? সরকারি হোমে....! ওটাই এখন ওর আস্তানা। সেদিন নীলাকে খুন করার পর নিজেই কৌশিকদের বাড়ীতে গ্যাছে, হাসতে হাসতে সব্বাইকে ডেকে ডেকে বলেছে ও নীলাকে খুন করেছে। তারপর? তারপর আর কি....যা হয় তাইই হলো! পুলিশ এলো। ডেডবডি উদ্ধার হলো, রাজাকে অ্যারেস্ট করলো। মানে যা হয় আর কি। কোর্টে কেস উঠলো। রাজার মানসিক ভারসাম্য ঠিক নেই বলে ওকে হোমে পাঠানো হলো! সবই হলো! শুধু রাজার সাথে সাথে সেদিন আমি আর অনিও ট্র্যাক ছেড়ে বেরিয়ে গ্যালাম। কৌশিক ঐ ঘটনার পর রাজাকে মারতে গ্যাছিলো। এলোপাথাড়ি মার খেতে খেতে রাজা বারবার একটাই কথা বলে গ্যাছে, “এভাবে বারবার হেরে যেতে ভাল্লাগে বল? তাই জিতে নিলাম একবার!” তারপর ৬টা বছর কেটে গ্যাছে। কৌশিক এখন নিউ ইয়র্কে, ওখানেই সেটল্‌ করবে। অনি একটা ব্যান্ড ফর্ম করেছে, ঐ নিয়েই থাকে। আর আমি? আমি ঐ ১০টা-৫টার ডিউটি। মাসে একবার করে হোমে যাই, রাজার সাথে দ্যাখা করতে। ওর জন্য রং-তুলি-কাগজ নিয়ে যাই, আর রাজা তাতে শুধুই চোখ আঁকে! দুটো বড় বড় টানা টানা চোখ! ভীষণ চেনা দুটো চোখ। রঙ দিতে বললে বলে, “রঙ তো শুধুই লাল! ওরম লাল কোথায় পাই বল তো? রক্তের মত লাল?” আগে যেতাম, এখন আস্তে আস্তে যাওয়া কমিয়ে দিয়েছি ওর কাছে। কি হবে গিয়ে? ঐ চোখদুটো দেখলেই যে মন ক্যামোন করে! এখন বুঝে গ্যাছি, জীবনের সব চাওয়া পাওয়ার হিসেব মেলে না। মিলতে পারে না। আমরা সব্বাই ঐ বাঁকটার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ি। পা ভারী হয়ে আসে, ইচ্ছে হয় বাঁকটা পেরিয়ে যেতে, শুধু পারিনা....পারিনা কারণ বাঁকের ওপারের মানুষটা দোসর হতে চায় কিনা কে বোঝে? তবু বাঁকটার সামনে গিয়ে দাঁড়াই আমরা...চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হয়, “বন্ধু হবে? ভালোবাসবে?” বারবার ছুঁয়ে দেখতে চাই ভালোবাসার নিয়মগুলো, আর বারবার ঘেঁটে যায়! শুধু গরাদের ওপারে থাকা ঘোলাটে চোখের কোনও এক প্রেমিক ঘড়ঘড়ে স্বরে আনমনে বলে ওঠে....

ধর একদিন এই সম্পর্কটা ভেঙ্গে গ্যালো,
তুই আর আমি আলাদা দুটো মানুষ হয়ে
যাব ঠিক করলাম আবার....
ঠিক করলাম যাবতীয় মান-অভিমান, মনখারাপের
রাত, খুনসুটি-আদর, গান প্রেম সব ভুলে যাব!
ডাকনাম গুলো গুরুত্বহীন ভাবে হয়তো বা
থেকে যাবে কোনো একটা চোরা অলিন্দে
অথবা নয়....
এরম একটা পরিস্থিতিতে অনেকদিন পর
হঠাৎ....হঠাৎ মুখোমুখি হলাম আমরা!
মুখ ঘুরিয়ে হেঁটে যাবি? নাকি আলতো হেসে
বলবি, “ক্যামোন আছিস”?
ঠিক এখন য্যামোন বলিস....

ধর একদিন এই সম্পর্কটা ভেঙ্গে গ্যালো,
তুই ভীষণ রাগ করে ফিরিয়ে দিলি
আমার দেওয়া সব উপহার....
কোনো কারণ ছাড়াই একের পর এক বাস ছেড়ে দেওয়া,
শুধু আমার সাথে আরেকটু থাকবি বলে,
অথবা ফুটপাথ ধরে এলোমেলো হাঁটতে হাঁটতে
আঙ্গুলে আঙ্গুল ছুঁইয়ে নেওয়া!
গলতে থাকা রোদটুকু শরীরে মেখে নিতে নিতে
পিছু ফিরে আরেকবার দেখে নেওয়া
তোকে, সাবধানে রাস্তা পেরোলি কিনা...
সব....এই সব কিছুই এক মূহুর্তে মিথ্যে
হয়ে গ্যালো! মিথ্যে হয়ে গ্যালো আমাদের একসাথে
খুঁজে নেওয়া খুশিয়াল সময় গুলো....
ডায়েরির পোড়া পাতার মত কিছু দুর্বোধ্য
অক্ষর শুধু লেগে আছে চোখের প্রান্ত সীমানায়!
এরকম একটা পরিস্থিতিতে অনেকদিন পর
হঠাৎ....হঠাৎ তোর খুব মনখারাপ!
আমায় ফোন করতে গিয়েও কল কেটে দিবি?
নাকি ঠোঁটে ঠোঁট ছুঁইয়ে
বলবি, “ক্যামোন আছিস”?
ঠিক এখন য্যামোন বলিস....

ধর একদিন এই সম্পর্কটা ভেঙ্গে গ্যালো,
একে অন্যকে অচেনা ভাবার শুরু....
বা ধর চিনতে না চাওয়ার অভিনয়!
নিজের মত করে ঐ একপ্রকার
দিনযাপন আর আপোষ গুলোকে
ভীষণ ভাবে আপন ভেবে নেওয়া....
অথবা কোনো একটা বৃষ্টির দিনে পচে যাওয়া
অনুভূতিগুলোকে নতুন করে বাঁচিয়ে তোলা!
কার্ণিশ বেয়ে নেমে আসা টুপ্‌টাপ
মনখারাপের দল ভীড় করেছে তোর
বিছানায়....অথচ তোর মুখ ছুঁয়ে আছে কোনো সোহাগী হাত!
এরকম একটা পরিস্থিতিতে অনেকদিন পর
হঠাৎ....হঠাৎ মুখোমুখি হলাম আমরা!
কোনো একটা নির্জন স্টেশানে,
তোর পাশে অন্য কেউ, যাকে আমি চিনতেও চাইনা!
আমি বললাম, “ক্যামোন আছিস”?
তুই কী আমায় চিনবি? বলবি, “খুব ভালো আছি”?
ঠিক এখন য্যামোন বলিস....

শুরু হয় শূণ্য থেকে শূণ্যে ফেরা....আলো থেকে আঁধার, আঁধার থেকে আলো! চোখ ধাঁধিয়ে যায় মাঝেমাঝে, তবু রক্তের ছাপ লেগে থাকা কাগজে ফুটে ওঠে ভীষণ চেনা সে আদল....!!Read at facebook patr-1 Read at facebook part-2

No comments:

Post a Comment

মনের কথা-Moner Katha