Monday 4 July 2016

"অতৃপ্ত"
-সৌরভ ভূঞ্যা (Sourav Bhunia)


মেসে আমরা ভালোই ছিলাম । কিন্তু, সমস্যা করল মেসের পাশে পুরানো একটা ভূতুড়ে বাড়ি । এই বাড়িটা নিয়ে নানারকম গুজব ছড়িয়ে আছে । স্থানীয় ছেলেদের মুখে শুনেছি রাতে নাকি এই বাড়ি থেকে নূপূরের আওয়াজ আর কুঁয়ো থেকেও নানারকম শব্দ শোনা যায় । মতিন, রমেশ, আর কেশব ছিল আমাদের মধ্যে একটু মাতব্বর । ওরা তিনজন ঠিক করল অমাবস্যার রাতে মোমবাতি নিয়ে ওই বাড়িতে রাত কাটাবে । আমাদের গ্রুপ, অর্থাৎ আমি, তারক, আর নয়ন ছিলাম ওদের তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বী । ওরা এত সহজে গুরুত্ব পাবে আর আমরা ছেড়ে দেব তা হয়না । তারক বলল, "আমরাও রাত কাটাবো ওখানে । কার কত সাহস দেখা যাবে !" প্রতিদ্বন্দ্বী দুইদলের সাহসের পরীক্ষায় রীতিমত সাজ সাজ রব আমাদের মধ্যে । একটা রটনাকে সত্যি করতে হবে- ব্যাপারটা যতটা উত্তেজক, ততটা কষ্টেরও । তারক কোথা থেকে এক জোড়া ঘুঙুর জোগাড় করেছে ।

দেখতে দেখতে অমাবস্যার দিন চলে এল । দিনটা ছিল শনিবার । কিন্তু, বাধ সাধল প্রকৃ্তি। বিকেল থেকেই মেঘ জমছে । কিন্তু, যে দল পিছিয়ে যাবে সেই দলকে ভীতু বলে ধরা হবে । অতএব, কেউই কাজ বন্ধ করলনা ।
রাত প্রায় এগারোটা । মতিন, কেশব আর রমেশ দুটো মোমবাতি নিয়ে বেরিয়ে গেল । খানিকবাদে আমরাও চললাম । ভূতুড়ে বাড়িটায় সীমানায় ঢুকেই ভয় জিনিসটাকে টের পেলাম । নয়ন সবাইকে বুঝিয়ে দিল কি করতে হবে । আমার উপর দায়িত্ব পড়ল ঘুঙুর বাজিয়ে বাড়ির চারদিকে ঘোরা । নয়ন কুঁয়োতে পাথর ফেলে শব্দ করবে । তারক দরজায় আওয়াজ করবে । কিন্তু টর্চ নেই, অন্ধকারে ঘুরতে হবে শুনে আমি একটু অস্বস্তি বোধ করছিলাম । কিন্তু পুরুষত্ব হারাবার লজ্জায় কাজ শুরু করলাম । একবার মত বাজিয়েছি- কড়্ কড়াৎ করে সামনে কোথাও বাজ পড়ল সাথে বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটা । বাধ্য হয়ে দরজা ঠেলে তিনজন ভেতরে ঢুকলাম । ওরা আমাদের ঢোকার আওয়াজে চমকে উঠল । তারক বলে উঠল, "ভয় নেই আমরাও তোদের অভিযানে যোগ দিতে এলাম ।" রমেশ বলল, "ভালোই হল । বসে পড় । একসাথে আনন্দ করাও যাবে আবার ভূতের দলের সাথে গল্পগুজবও করা যাবে ।" সবাই বসে পড়ে ঠিক করলাম গানের লড়াই হবে । প্রথম আমার পালা । বাইরে তুমুল ঝড়বৃষ্টি আর বাজ পড়ার শব্দ ।
"পাগলা হাওয়ায়, বাদল দিনে..." গান সবে শুরু করেছি- প্রবল ঝোড়ো হাওয়ায় জানলাটা খুলে গিয়ে মোমবাতিটা নিভে গেল । আমার হাতঘড়ির রেডিয়ামের আলোয় দেখলাম রাত্রি পৌনে বারোটা । হঠাৎ শুনলাম বাইরে যেন নূপূরের শব্দ, ঝুম্ ঝুম ঝুম । প্রথমে ভাবলাম মনের ভূল । কিন্তু না, একে অপরকে খোঁচা দেওয়াতে বুঝলাম সবাই শব্দটা শুনেছে । হঠাৎ আমাদের সামনে কিছু একটা যেন ধপ করে পড়ল । আমি চীৎকার করে দরজার দিকে দৌড়োলাম, সাথে সাথে সবাই । কিন্তু দরজা কেউ বাইরে থেকে লক্ করে দিয়েছে । ভয়ে আমার আত্মারাম খাঁচাছাড়া হওয়ার জোগাড় । কোনোরকমে জানালাটার কাছে এলাম সবাই । প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টি শুরু হয়েছে বাইরে, ঘনঘন বাজ পড়ার আওয়াজ যেন পোড়ো বাড়িটাকে মাটিতে মিশিয়ে দেবে । বাইরের ঠান্ডা হাওয়া আর শিরদাঁড়া দিয়ে বয়ে যাওয়া হিমশীতল স্রোতে পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে পড়লাম সবাই । চাইলেও নড়ার ক্ষমতা নেই । একি দেখছি আমরা ! দেখলাম ওই ঝড়বৃষ্টির মধ্যেও একটা একুশ-বাইশ বছরের বিবাহিতা যুবতী দৌড়ে যাচ্ছে আর তাকে ধরতে পেছনে ছুটে চলেছে একজন আন্দাজ বছর পঁচিশের যুবক । ব্যাপারটা তাদের কাছে যতটা রোমান্টিক, আমাদের কাছে ততটাই ভয়ের হয়ে উঠছে । দেখলাম, এতক্ষন যাদের মুখে-চোখে সাহসিকতার বীরদর্প ফুটে বেরোচ্ছিল, তাদের সবার মুখই ভয়ে ফ্যাকাশে হয়ে গেছে । কিন্তু যুবতীটি ওদিকে ছুটছে কেন ! ওদিকে তো কুঁয়োটা আছে.... আমার মনের কথাটা মনেই রয়ে গেল... যুবতীটি কুঁয়োতে পড়ে গেল, যুবকটি কিছু বলা বা করারই সময় বা সুযোগ পেলনা ... সেও ঝাঁপ দিল কুঁয়োয় । নিমেশের মধ্যে ঘটে গেল সবকিছু । এদিকে ধপ করে মেঝেতে উল্টে পড়ল তারক । আমরা তাকে ধরে এনে শুইয়ে দিলাম ঘরের মধ্যে । চোখেমুখে বৃষ্টির জল হাতের চেটোয় ধরে এনে ঝাপটা দিলাম । তারকের কখন জ্ঞান ফিরেছিল জানিনা । সারারাত কেউ আর ঘুমোইনি । নিঃশব্দেই জেগে রইলাম ।
ঝড়বৃষ্টি কখন যেন থেমে গেছে খেয়াল করিনি । ভোরের প্রথম আলো ঢুকছে জানলা দিয়ে । দরজাটাও কে খুলে রেখে গেছে । অল্প আলোয় দেখলাম ঠিক সামনেই মেঝেতে পড়ে রয়েছে একটা সুন্দর লাল মলাটে বাঁধানো ডায়েরী । রাতের ধপ করে হওয়া শব্দের কারনটাএখন বুঝলাম ।
সবাই ফিরে এলাম মেসে ।
দুপুরের খাওয়াদাওয়ার পর সবাই বসলাম ডায়েরীটাকে নিয়ে । ১৯৯৪ সালের ছোট্ট ডায়েরীটার কয়েকটা মাত্র পাতায় লেখা । মলাটের উপর লেখা "শ্রী সুভাষ দাশ" । আমি পড়া শুরু করলাম-
"১৭ই মার্চ
আজ মনিকাকে কলেজে প্রথম দেখলাম । আমি কলেজের সিঁড়ি দিয়ে উঠছিলাম, ও নামছিল । পা পিছলে আমার উপরে পড়ে । কোনোরকম সামলে নিয়ে হাত ধরে তুলে দেওয়ার পর আর দাঁড়ায়নি । লজ্জায় মাথা নীচু করে চলে গেল । কিন্তু ওর স্পর্শে আমার মনে কেমন যেন করে উঠল, সারা জীবনেও ভূলবোনা তা ।

১৮ই মার্চ
মেয়েদের ব্যাপারে কোনোদিনই আমার কৌতূহল ছিলনা । কিন্তু, মনিকার মুখে যেন আমি পৃথিবীর সব সুন্দর জিনিস দেখতে পাই, ঠিক যেন আমার স্বপ্নে দেখা রাজকন্যে, একটা ফুটন্ত লাল গোলাপ যেন । ক্লাসে শুধু ওর দিকেই তাকিয়ে থাকি আমি ।

২০ই মার্চ
আর পড়তে ইচ্ছে করেনা । পড়া, খাওয়া, ঘুমানো সব কোথাও উধাও হয়ে গিয়েছে । শুধু মনিকাকেই ভাবি আমি ।

২১শে মার্চ
আজ ক্লাসে ওর দিকে আমাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে মুচকি হেসেছিল । বোকার মত পাল্টা আমিও ।

২২শে মার্চ
আজ বাড়ি ফেরার সময় মনিকার ঠিক পিছনেই ধীরে ধীরে সাইকেল চালিয়ে ফিরছিলাম আমি । হঠাৎ ওর সাইকেলের চেনটা পড়ে গেল পেছনে হঠাৎ আমাকে দেখে অপ্রস্‌তুতভাবে সাহায্য চায় । চেনটা তুলে দেওয়ার পর নতমুখে ধন্যবাদ জানিয়ে বলে, 'আজ তুমি না থাকলে খুবই বিপদে পড়তাম....' হঠাৎ ওর দিকে আমাকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে বলে 'কিছু বলবে?' আনমনে দু-তিনবার ঢোক গিলে বলেছিলাম হ্যাঁ, আমি তোমাকে ভালোবাসি । তারপর আর দাঁড়াইনি দৌড়ে খানিকটা দূরে এসে দেখলাম আমার দিকে তাকিয়ে ও হাসছে ।

২৪শে মার্চ
কাল ভয়ে কলেজ যাইনি । আজ গিয়েছিলাম । সারাজীবন ধরে প্রথম বেঞ্চে বস, ছাত্র আমি, আজ চোরের মত মুখ লুকিয়ে শেষ বেঞ্চে বসেছি । মুখ নীচু করে দেখছি মনিকা বারবার ফিরে ফিরে তাকাচ্ছে আমার দিকে । কলেজ ছুটি হতে ধীরপায়ে বেরিয়ে দেখি মনিকা একা দাঁড়িয়ে আছে দরজার পাশে । আমাকে ঈশারায় কাছে ডাকলো, মুখোমুখি দুজনে গিয়ে বসলাম ক্যান্টিনের ছোট্ট গোল একটাটেবিলে । কফির অর্ডার দিলাম আমি । আমিও তোমাকে ভালোবাসি' কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে বলে উঠল মনিকা ।
এখন আমি অনেকটাই স্বাভাবিক । কথায় কথায় জানতে পারলাম এককালে ওদের প্রচুর সম্পত্তি ছিল । কিন্তু ওর বাবার ক্যানসার হয়ে মারা যাওয়ার সময় চিকীৎসা করাতে আর পারলৌকিক কাজ করে উঠতে গিয়ে সমস্ত বিক্রী হয়ে গেছে । এখন ওরা খুবই গরীব । ওর মা লোকের বাড়ীতে কাজ করে সংসার খরচ চালান আর টিউশান পড়িয়ে নিজের পড়া চালাচ্ছে । ওর একটা ছোট্ট ভাইও আছে, ক্লাস এইটে পড়ে ।

৭ই এপ্রিল
এখন আর ডায়েরী লেখা হয়ে ওঠেনা । চুটিয়ে প্রেম করছি আমরা । তবে এই নিয়ে বাবার সাথে আমার বিস্তর ঝামেলা হয়েছে । বাবা কিছুতেই এই সম্পর্কটা মেনে নিতে চাইছেন না ।

২১শে এপ্রিল
কাল রাতে বাবা বলেছিলেন আমাকে যে কোন একদিক বেছে নিতে একদিকে বাবা-মা আর একদিকে মনিকা । আমি জীবনে কোনোদিন বাবার অবাধ্য হইনি । কিন্তু আজ জীবনের সবথেকে বড় সিদ্ধান্তটা নিয়েই নিলাম । মনিকাকে মন্দিরে বিয়ে করেছি । ভেবেছিলাম বাবা হয়তো মেনে নেবেন, কিন্তু নেননি । যাইহোক, শ্যামলের কাছ থেকে একটা বাড়ি উপহার পেয়েছি, এখানেই উঠেছি । শ্যামল আমার খুব ভালো বন্ধু, খুব বড়োলোক বাড়ির ছেলে । ওর বাবা মারা যাওয়ার পর সমস্ত সম্পত্তির মালিক ও । ওর ভরসাতেই আমি আজ এতটা সাহস পেয়েছিলাম বাবাকে অমান্য করার । আর বন্ধুর জন্য কোনো কার্পন্যও করেনি ও । বাড়িটা পুরো আমাদের নামে লিখে দিয়েছে । বলেছে সামনের মাসে একটা চাকরীও জোগাড় করে দেবে আমাকে ।

৪ই জুন
অনেকদিন ডায়েরী লেখা হয়নি আর নানান ব্যস্ততায় । আমি একটা ছোট্ট অফিসে কাজ করি আর মনিকা টিউশান করে বাড়িতে । খুব ভালোভাবেই দিন কাটছে আমাদের । খুব আনন্দেই আছি আমরা । তবে বাবা আর কোনো খবরও নেননি, এই বেদনাটা মনিকার মুখের দিকে তাকালেই কোথায় হারিয়ে যায় । আরও একটা খুশির কথা হল, আমি বাবা হতে চলেছি । শ্যামল মাঝে মাঝে আসে দেখা করতে ।
আজ খুব ঝড়বৃষ্টি হচ্ছে । একি ! মনিকা এই অসময়ে ঝড়বৃষ্টিতেও ভিজতে বেরিয়েছে ! বাচ্চামেয়ের মত এদিক ওদিক দৌড়চ্ছে আর নাচছে । যেন পাগলী একটা । বৃষ্টি ওর খুব প্রিয় । কিন্তু....."

ডায়েরীটা তারপর আর কোনওদিন কেউ লেখেনি । ধূলো জমা ডায়েরীটাকে নিশ্চয়ই পরে কেউ তাকে তুলে রেখে গেছিল ।
বাকিটা আর আমাদের বুঝতে অসুবিধা রইলনা । সুভাষ সেদিন মনিকাকে বাঁচাতে পারেনি । তাই ওদের অপঘাতে মারা যাওয়া অতৃপ্ত দুটি আত্মা আজও একই কান্ড বারবার ঘটিয়ে যায় । হঠাৎ তারকের চোখ গেল ক্যালেন্ডারের দিকে । আজ ৫ই জুন ।

কয়েকদিন পর খবর পেলাম রমেশরা বিহার যাচ্ছে । ওর বাবা ওর দাদুর পিন্ডদান করবেন । আর ওরা নালন্দা ঘুরে দেখবে । আমরা চাঁদা তুলে রমেশকে দিলাম সুভাষ আর মনিকার পিন্ডদানের জন্য । এরপর আর কোনোদিন ওই বাড়ি থেকে আর কোনও আওয়াজ পাওয়া যায়নি । কিন্তু দুটো আশ্চর্যের ব্যাপার পরে মাথায় এসেছে। এক, সুভাষ-মনিকা কি সেদিনের পুরো ঘটনাটা সেই তারিখেই আমাদের জানাতে সেদিন ডায়েরীটা ফেলেছিল? এর উত্তর আমরা আজও পাইনি । আর আমরা ডায়েরীটা পড়ার পর থেকেই সেটা কোথায় হারিয়ে গেছে....
 Read at facebook

No comments:

Post a Comment

মনের কথা-Moner Katha